Post Thumbnail

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের চরম অবনতির নেপথ্যে কি?


ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের চরম টানাপোড়েনের মধ্যে আজ এক সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় এসেছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর এটিই প্রথম ভারতীয় কোন শীর্ষ কটূনীতিকের ঢাকা সফর। বিক্রম মিশ্রি এমন এক সময় ঢাকা সফর করছেন যখন ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময় অতিক্রম করছে। সুতরাং যে কোন বিবেচনায় এই সফর অন্তত তাৎপর্যপূর্ণ। ঢাকায় এসে আজ বিক্রম মিশ্রি সকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দুই দেশের পররাষ্ট্র কর্মকর্তাদের বৈঠকে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক হয়েছে। সেখানে চলমান এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে উভয় পক্ষ একমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কতদূর কি হবে তা নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহের অন্ত নেই। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। এই অবস্থার আরও চরম অবনতি শুরু হয় গত ২৫ নভেম্বর রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় বাংলাদেশের সম্মিলিত সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের পর। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন দুই ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় আন্দোলন শুরু করে বিজেপি এবং তার অন্যান্য মিত্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। সেই ধারাবাহিকতায় সোমবার ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় বাংলাদেশের হাইকমিশন কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়েছে হিন্দু সংঘর্ষ জোট নামের একটি সংস্থার শতাধিক কর্মী-সমর্থক। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও এ ঘটনাকে ‘খুবই দুঃখজনক’ বলে উল্লেখ করেছে। হাইকমিশন কার্যালয়ে হামলার অভিযোগে ইতোমধ্যে ৭ জনকে গ্রেপ্তারও করেছে ত্রিপুরা পুলিশ। এসমস্ত ঘটনার প্রতিবাদে আজ বিএনপির ৩ (যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল) অঙ্গ সংগঠন ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনে স্মারকলিপি জমা দিয়েছে। অন্যদিকে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন ঘেরাওয়ের ঘোষণা দিয়েছে দেশটির উগ্রপন্থী কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস। আগামী ১০ ডিসেম্বর এই ঘেরাও কর্মসূচি করা হবে। এর ফলে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের শেষ পরিণতি কি হবে তা নিয়ে সর্বত্র এক ধরনের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং অস্থিরতা।

আপাতভাবে মনে হতে পারে যে শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় গ্রহণ এবং চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তারই বাংলাদশ এবং ভারতের সাম্প্রতিক টানাপোড়েনের উৎস বা কারণ; কিন্তু সত্য হলো—এই টানাপোড়েনের শেকড় অনেক গভীরে। আমরা যদি এর কারণ অনুসন্ধান করতে চাই তাহলে আমাদের একটু পেছনে ফিরতে হবে। আর তা হলো ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পাকিস্তান হানাদারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। এ সময় বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল ভারত। সেই ভারতের সঙ্গে আজ বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের চরম অবনতি। পঁচাত্তরের পরবর্তীতেও ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এতো খারাপ হয়নি। এখানে উল্লেখ্য যে, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি একটি বিশেষ গোষ্ঠী। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। যারা এই বিরোধিতা করেছিল মূলত ভারতবিরোধিতার দর্শন থেকে। তারা মনে করেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত অংশগ্রহণ করেছিল শুধুমাত্র তাদের স্বার্থের কারণে। এই প্রেক্ষাপটে সবসময় এই গোষ্ঠী ভারতবিরোধিতা করে আসছে। স্বাধীনতার পরও তারা বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতার এক নীরব প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে।

বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত তিনটি ধারায় বিভক্ত। এর মধ্যে একটি গোষ্ঠী হলো তারা, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী ছিল, জামায়াতে ইসলাম। দ্বিতীয়টি হলো মধ্যপন্থি। তারা হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। তারা মনে করে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে ভালো কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখা উচিত। এই ধারার মধ্যে আবার দুই ধরনের মতাদর্শী রয়েছে। এক দল মনে করে ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশীসূলভ কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকা উচিত। আরেকটি পক্ষ মনে করে একটি সন্মানজনক সম্পর্ক থাকতে পারে। তৃতীয় আরেকটি পক্ষ মনে করে, ভারত আমাদের প্রতিবেশী। যে কোন মূল্যে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রাখা উচিত। এই মতাদর্শী হলো আওয়ামী লীগ। তারা গত সাড়ে ১৫ বছরে ভারতের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রেখে চলেছে। তবে এ সময় তাদের দুর্নীতি, লুটপাট এখন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলেছে। দেশের মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে এবং এই মনোভাবকে কাজে লাগাচ্ছে একাত্তরের পরাজিত শক্তি। 

এখন প্রশ্ন হলো, ভারত-বাংলাদেশের চলমান এই সম্পর্কে কে বেশি লাভবান হবে? আসলে কেউই লাভবান হবে না। ভারত-বাংলাদেশ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারত-বাংলাদেশ উভয় উভয়ের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ যেমন ভারত থেকে পেঁয়াজ, আলু, চাল, চিনি সহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি করে তেমনি ভারতের অখন্ডতার জন্য বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের ভূখন্ড যেন কেউ ব্যবহার করতে না পারে সেটা ভারতের জন্য একটি বড় বিবেচ্য বিষয়। সাম্প্রতিক সময় বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক নতুন করে গাঢ় হতে শুরু করেছে। সেটিও ভারতের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়। কারণ ভারত-পাকিস্তান চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুইটি দেশ। এছাড়া বাংলাদেশের একটি বিরাট অংশের মানুষ চিকিৎসার জন্য নিয়মিত ভারতে যান। অর্থাৎ একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অনেকগুলো বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এরকম বাস্তবতায় প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ রেখে কেউই লাভবান হয় না। এই বাস্তবতা ভারত-বাংলাদেশ উভয়কেই উপলদ্ধি করতে হবে। যারা বাংলাদেশে একচেটিয়া ভাবে ভারত বিরোধিতা করছে তাদের বুঝতে হবে যে, শুধু ভারত আমাদের ওপর নির্ভরশীল নয়, আমরাও ভারতের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং একচেটিয়া ভাবে ভারতের বিরোধিতা করে প্রকৃতপক্ষে কোন পক্ষই লাভবান হবে না। লাভবান হবে শুধুমাত্র একাত্তরের পরাজিত শক্তি। 


Comments

Leave a Comment


Related Articles