Post Thumbnail

নতুন শঙ্কায় বিএনপি


৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে আনন্দিত এবং উল্লাসিত দলটির নাম ছিলো বিএনপি। বিএনপি’র নেতা-কর্মীদের দেখে মনে হচ্ছিল একটি জগদ্দল পাথর তাদের বুক থেকে সরে গেছে। মুক্তির আনন্দে তারা ছিলো উদ্দে লিত। এসময় বিএনপি’র কিছু বেপরোয়া তৎপরতাও চোখে পরেছিলো। বিভিন্ন স্থানে হামলা, লুটপাট ও দখলদারিত্বের এক উন্মত্ত খেলায় মেতে উঠেছিলো দীর্ঘ ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। কিন্তু বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্ব অত্যন্ত সচেতনভাবে এসব উশৃংখলতার লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করে। সব জায়গায় যে তারা সফল হয়েছে এমনটি নয়। তবে, তারা জনগণের কাছে সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে বিএনপি দলগতভাবে এসমস্ত উশৃংখলতা, লুটপাট ও দখল পছন্দ করে না। বিএনপি’র এই এবং রাজনৈতিক দূরদর্শীতা সকলের কাছেই প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষ করে যেখানেই দখল, ভাঙচুর, প্রতিশোধের উন্মত্ততা দেখেছে সেখানেই শীর্ষ নেতারা হস্তক্ষেপ করেছে। দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে অনেককে। অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এই বার্তাটি দিয়ে বিএনপি তাদের নিজেদের অবস্থান সুস্পষ্ট করেছে। 

অনেকেই মনে করে, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে নির্বাচন হলে বিএনপি’র নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত। বিএনপি গত ১৭ বছর নানা রকম সংকটের মুখে নিপতিত ছিলো। তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা এবং দমন নীতি চলেছিলো নিরন্তর। কিন্তু তারপরও বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি ঐক্যে অটুট ছিলো। তাদের সংগঠন তারা ধরে রাখতে পেরেছিলো। এটি নিঃসন্দেহে বিএনপি’র সবচেয়ে বড় সাফল্য। কিন্তু পাশাপাশি এটিও সত্য যে, আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি দীর্ঘ ১৭ বছর সফল আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে নি। এমনকি ৫ আগস্টের যে গণঅভ্যুত্থান তাতেও বিএনপি পার্শ্বচরিত্রে ছিলো মাত্র। বিএনপি’র নেতৃত্বে এই এই আন্দোলন পরিচালিত হয়নি। বিএনপি এই আন্দোলনের প্রধান শরিকও নয়। আর এই কারণে এই আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি তার প্রধান প্রতিপক্ষকে হটাতে পারলেও এই আন্দোলনের পুরো কৃতিত্ব তাদের নয়। বরং বিএনপি’র চেয়ে এ আন্দোলনের বেশি কৃতিত্ব দেয়া হয় শিক্ষার্থী এবং জামায়াত ও শিবিরসহ বিভিন্ন দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোকে। অবশ্য বিএনপি’র নেতারা বিভিন্ন সময়ে বলার চেষ্টা করেছেন যে, দীর্ঘদিন ধরে তারা যে আন্দোলন করেছে সেই আন্দোলনেরই ধারাবাহিকতা হলো ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান। কিন্তু বিএনপি’র নেতারা যা বলুক না কেন সাধারণ মানুষ মনে করে এই আন্দোলনের আসল নেতা হলেন শিক্ষার্থীরা। আরো নির্দিষ্ট করে বললে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বাস্তবতা হলো কোটা সংস্কার আন্দোলনেই শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে।

অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বলেছেন, এটি ছিলো ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান এবং এ অভ্যুত্থানের ‘মাষ্টার মাইন্ড’-কে তিনি আন্তর্জাতিক ফোরামে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে অন্তবর্তীকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে ড. ইউনূস আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের অন্তবর্তীকালীন সরকারের ‘নিয়োগ কর্তা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এই গণঅভ্যুত্থানের ফলে যে অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে সেই সরকার তিন মাস যেতে না যেতেই নানারকম সংকট এবং সমস্যার মুখোমুখি। যে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ছাত্র জনতা গণঅভ্যুত্থান সফল করেছিলো সেই জনসমর্থনে এখন ভাটার টান। অন্যদিকে সাংগঠনিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী বিএনপি একটি সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তি। আওয়ামী লীগ যখন বিপর্যস্ত, আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা যখন পলাতক তখন একথা অস্বীকার করার কোন কারণ নেই যে, বিএনপি এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান শক্তি। আর একারণেই বিএনপি এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিক কিংবা না দিক সরকারের নীতি নির্ধারনে দলটি এখন একটি বড় ফ্যাক্টর। বিএনপিকে বাদ দিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার কোন গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারনের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কিনা তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সংশয়-সন্দেহ রয়েছে। ১৭ বছর পর ক্ষমতায় না থেকেও একটা দারুণ স্বস্তির সময় উপভোগ করছে বিএনপি। কিন্তু তারপরও বিএনপি’র মধ্যে নানা রকম শঙ্কা, সন্দেহ ক্রমশ: প্রকাশ্য হচ্ছে। নানা কারণেই বিএনপি’র মধ্যে শঙ্কার কালো মেঘ। বিএনপি’র অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন, আন্দোলনের ফসল শেষ পর্যন্ত তারা ঘরে নাও তুলতে পারে। শেষ পর্যন্ত এই গণভ্যুত্থানের লক্ষ্যচ্যুতি ঘটতে পারে। চূড়ান্ত বিজয়ের দাঁড়প্রান্তে গিয়েও বিজয় তাদের হাতছাড়া হতে পারে। প্রতি বিপ্লব বা অনভিপ্রেত কিছু ঘটার শংকার কথাও বলেছেন বিএনপি নেতারা।  

সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে সৃষ্ট সংকটে বিএনপি’র সঙ্গে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দূরত্ব প্রকাশ্য রূপ লাভ করেছে। বিএনপি অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচন চাইছে। বিএনপি’র প্রধান দাবি, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচন। তবে এখনও এই দাবি নিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকারের উপর কোন চাপও সৃষ্টি করেনি। তবে, বিএনপি’র পক্ষ থেকে এই বক্তব্যটি ক্রমশঃ প্রধান হয়ে সামনে আসছে। বিএনপি’র নেতারা এখন বিভিন্ন ফোরামে বেশ জোড় দিয়েই একথাগুলো বলছেন। অন্যদিকে অন্তবর্তীকালীন সরকার যে প্রক্রিয়ায় এগুচ্ছে তাতে আপাতত চটজলদি নির্বাচন হবারও কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা পদত্যাগ করেছেন। সরকার নতুন নির্বাচান কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া এখনও শুরু করেনি।  নির্বাচনের জন্য ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে একটি সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই সংস্কার কমিটির ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার কথা। এই প্রতিবেদন পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ হবে এছাড়াও আরো বিষয়ে সংস্কারের প্রক্রিয়া এখন চলমান এবং এ লক্ষ্যে কিছু কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তারমধ্যে উল্লেলখযোগ্য হলো সংবিধান সংস্কার। এসব সংস্কার কমিটির সীমা-পরিসীমা এখনও পরিস্কার নয়। সংস্কারের পর কি হবে সে বিষয়টিও অস্পষ্ট। 

বিএনপি মনে করছে যে, এইধরনের সংস্কার প্রক্রিয়াগুলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে এবং দীর্ঘ শুত্রিতার পথে যাবে। বিএনপি’র কেউ কেউ এক-এগারোর কথাও স্বরণ করছেন। এমনকি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘এক-এগারোর কথা বিএনপি ভুলে যায়নি’। আবার একটি অনির্বাচিত সরকার অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকুক এটি বিএনপি স্পষ্টতই চায় না। আর এই না চাওয়ার ইচ্ছে থেকেই বিএনপি’র মধ্যে রাষ্ট্রপতি নিয়ে অন্যরকম চিন্তা বলে ধারণা করা যেতে পারে। যদি এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতিকে অভিসংশন করা হয় বা রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেয়া হয় তাহলে একটি সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে। একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করা হলে বাংলাদেশে নির্বাচনের সময় অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে যাবে। বিএনপি এটা চায়না। বিএনপি যেকোন মূল্যে বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট এবং যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে চায়। আর এই নির্বাচন করতে গেলে বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে স্ব-পদে বহাল থাকতেই হবে। নাহলে এই সংবিধান পুরোপুরি বাতিল করতে হবে। একটি বিপ্লবী সরকার গঠিত হলে নতুন সংবিধান প্রণয়ন, এই সংবিধান গ্রহণ এবং জনমত নেয়ার মতো জটিল প্রক্রিয়াগুলো সারতে হবে। যেটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। বিএনপি সেই পথে যেতে আগ্রহী নয়। আর সেই কারণে তারা মনে করছে নির্বাচন সংস্কারসহ জরুরী সংস্কার গুলো সম্পন্ন করেই যেন অন্তবর্তীকালীন সরকার বর্তমান সংবিধানের আওতায় নির্বাচন দেয়। 

বিএনপি’র সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কেবল রাষ্ট্রপতি বিষয় ছাড়াও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে দূরত্ব ও বিরোধ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এছাড়া বিএনপি’র আন্দোলনের অন্যতম মিত্র জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব নিয়েও চর্চা হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। জামায়াত যেমন সংখ্যানুপাতিক হারে সংসদ নির্বাচন চাইছে বিএনপি তা চাইছে না। সরকারের বিভিন্ন স্থানে জামায়াত সমর্থিত ব্যক্তিদের প্রাধান্য বিএনপিকে উদ্বিগ্ন করেছে।

গত তিন মাসে অন্তবর্তীকালীন সরকার যেভাবে দেশ পরিচালনা করেছে তাতে খুশী নয় বিএনপি। তারেক জিয়ার দেশে ফেরাও বিলম্বিত হচ্ছে। নানা সমীকরণ মিলিয়ে বেগম জিয়াও আপাতত: বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন না। বিএনপি মনে করছে নির্বাচন যতো পেছাবে ততো তাদের জন্য ক্ষমতায় যাওয়ার পথ বন্ধুর হয়ে যাবে। শুধু এটি নয়, বিএনপি মনে করছে নির্বাচন পেছানো মানেই একটি অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে চালু হওয়ার শঙ্কা। এতে তারাও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে এখন রাজনীতিতে যে মেরুকরণ তা বিএনপি’কে একটি প্রকাশ্য সংকটের মধ্যে ফেলেছে। যে আন্দোলনে বিএনপি’র নেতৃত্ব ছিলো না সেই আন্দোলনের ফসল অন্তবর্তীকালীন সরকারকে বিএনপি যা বলবে তা কি ড. ইউনূসের সরকার মানবে? শিক্ষার্থীরা নিঃসন্দেহে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান শক্তি। তাদের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিএনপি কি নিজস্ব অবস্থানে অটল থাকতে পারবে? বিএনপি’র জন্য এখন দ্বিমুখী সংকট। একদিকে তারা রাষ্ট্রপতি’র অভিসংশন মেনে নেয় তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হবে তৃতীয় পক্ষ। আর যদি বিএনপি এই অভিসংশনের সিদ্ধান্ত না মানে তাহলে শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের মুখোমুখি প্রতিপক্ষ হবার শঙ্কা রয়েছে। যা রাজনীতিতে একটি নতুন সংকট সৃষ্টি করবে। বিএনপি এখন কোন পথে যায় সেটিই দেখার বিষয়।  


Comments

Leave a Comment


Related Articles