Post Thumbnail

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তদন্ত: রিপোর্ট যেন আলোর মুখ দেখে


৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন রকম অভিযান পরিচালিত হচ্ছে না, বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের বিরুদ্ধেও নানা রকম অভিযোগ উঠেছে, মামলা হচ্ছে। প্রশাসনের আমলা থেকে শুরু করে গণমাধ্যমের একাংশকে সাবেক সরকারের দোসর এবং গণহত্যার মদদ দাতা হিসেবে চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ দৃশ্যমান। যদিও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ৮ আগস্ট ক্ষমতা গ্রহণের আগে এবং পরে অন্তত দু’বার বলেছেন, ‘বাংলাদেশ একটি বৃহত্তর পরিবার। আমরা কারো প্রতিপক্ষ নই।’ কিন্তু তিনি যেই কথাই বলুক না কেন বাস্তবতা হলো আওয়ামীপন্থি হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
 
বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মধ্যে যে একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছিলো এটি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। অনেকে নানা রকম প্রত্যাশায় সরকারের ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা করেছিলেন। চাটুকারিতা-মোসাহেবী করে সরকারের আস্থাভাজন হয়ে বাড়তি কিছু আদায়ের চেষ্টা করেছিলো এটি অস্বীকারের কোন কারণ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো যাদেরকে আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে ট্যাগ লাগানো হচ্ছে তাদের সবাই কি আওয়ামীপন্থি? কিংবা যারা সত্যি সত্যি গত ১৫ বছর বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছে, নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে সরকারের লেজুড় বৃত্তি করেছে তারা সবাই কি এই তালিকাভুক্ত হচ্ছে? এই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। 

বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরেই গণমাধ্যমে যারা আওয়ামীপন্থি হিসেবে পরিচিত তাদের ব্যাপারে অত্যন্ত সোচ্চার। এনিয়ে সরকারের একাধিক উপদেষ্টা বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন। গণমাধ্যমে যারা আন্দোলনকে সমর্থন করেনি, আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান করেছে তাদেরকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, গত ১৫ বছরে যারা এই সরকারকে সমর্থন করেছে, তাদের এখন ‘দালাল’ তকমা দেয়া হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের এক অতি পরিচিত নিয়তি। দেখা যায় যে, একটি সরকারের বিদায়ের পর আরেকটি সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে বিদায়ী সরকারে যারা গণমাধ্যম কর্মী ছিলো তাদের বিরুদ্ধে নানা রকম হয়রানি এবং নিপীড়ন মূলক ব্যবস্থা নেয়। তবে এবারের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন ধরনের এবং আগ্রাসী। ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম গণমাধ্যম কর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা মামলা দায়ের করা হতে থাকে। এপর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২’শর বেশি গণমাধ্যম কর্মীকে হত্যা মামলায় আসামী করা হয়েছে। এদের মধ্যে যেমন জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিকরা আছেন, তেমনি মাঠ পর্যায়ের স্থানীয় সাংবাদিকদেরও বাদ দেয়া হয়নি। এই মামলাগুলোর মধ্যে ইতোমধ্যেই একটি নেতিবাচক মতামত উঠে এসেছে। এধরনের ঢালাও হত্যা মামলা বা জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতদের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলে ব্যারিস্টার সারা হোসেনসহ একাধিক আইনজীবী মন্তব্য করেছেন। এছাড়াও কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালেও মামলা করা হয়েছে।

এই হত্যা মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ কি হবে বা হত্যা মামলাগুলোর ফলে গণমাধ্যমের পরিস্থিতি কি হবে সেটি নিঃসন্দেহে ভেবে দেখার বিষয়। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই ধরনের হত্যা মামলায় তদন্ত ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না। তবে সরকার তার তিন মাসের কাছাকাছি সময়ে এসে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নতুন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছে। এরকম দু’টি পদক্ষেপ উল্লেখ করার মতো।  

প্রথমত, বেশ কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মীর (২০ জন) অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে। অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড একজন সংবাদ কর্মীর সরকারি স্বীকৃতি। তিনি এই কার্ডের মাধ্যমে সরকার কর্তৃক সাংবাদিকতা পেশার জন্য স্বীকৃত হন। এই কার্ড ব্যবহার করে তিনি সচিবালয়ে প্রবেশ করতে পারেন। অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড যাদের বাতিল করা হয়েছে তারা সবাই পেশাদার সাংবাদিক এমনটিও নয়। এদের কেউ কেউ এখন সাংবাদিকতা পেশায় নেই। অনেকে এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে যে, অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করা কি খুব জরুরি ছিলো? এটির মাধ্যমে তথ্য মন্ত্রণালয় বা সরকার কি বার্তা দেয়ার চেষ্টা করলো? এই অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিলের মাধ্যমে কি সরকার বোঝাতে চাইলো যে, যাদের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে তারা সাংবাদিক হওয়ার অযোগ্য? এরা যদি আওয়ামী লীগপন্থি জন্যই এই সিদ্ধান্তের আওতায় পড়েন সেক্ষেত্রে এদের চেয়েও যারা আলোচিত-সমালোচিত তাদের কার্ড বাতিল হলো না কেন? সরকার কি তাহলে আওয়ামীপন্থিদের  মধ্যেও ‘পিক এন্ড চুজ’ নীতি গ্রহণ করেছে?

এই অ্যাক্রেডিটেশন কার্ডের হুলস্থুলের মধ্যেই আরেকটি তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আর তা হলো, তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব স্বাক্ষরিত এক ‘অতি গোপনীয়’ চিঠিতে ২৮ জন সাংবাদিকের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে বিএফআইইউ (বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট)-কে এই নামের তালিকা তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো হয়েছে এবং তাদের ব্যাংক হিসেব খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমি মনে করি, এটি অত্যন্ত ভালো একটি উদ্যোগ। সাংবাদিকতা পেশার স্বচ্ছতার জন্য এর জবাবদিহিতা জরুরী। জনগণের জানার অধিকার আছে তাদের সম্পদের পরিমাণ কি? 
 
তবে এই ২৮ জনের তালিকা দেখেও কিছুটা বিস্মিত হতে হয়। এমন কিছু ব্যক্তির নাম এই তালিকায় নেই যাদের নিয়ে সাধারণ মানুষের নানা রকম প্রশ্ন আছে। যেসমস্ত গণমাধ্যম কর্মীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদের কথা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোনা যায়। তাদের অনেকেরই নাম এই তালিকায় নেই। কোন চাকরী ছাড়াই যারা রাজকীয় জীবন যাপন করেন, তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেয়া হলো কেন? এদের সঙ্গে কি তাহলে সরকারের গোপন আঁতাত হয়েছে? আবার এই তালিকায় এমন কয়েকজনের নাম আছে যারা পেশাদার সাংবাদিক এবং ভিন্ন মত থাকলেও তাদের নৈতিকতা এবং সততা প্রশ্নাতীত। 

এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে সরকার এই তদন্তের মাধ্যমে কি অর্জন করতে চায়? সরকার যদি সত্যি সত্যি জানতে চায় যে, আলোচিত এই ২৮ জন গণমাধ্যমকর্মী দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কিনা? অবৈধভাবে কোন অর্থ উপার্জন করেছে কিনা? তাহলে এই তদন্তের উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং ভালো উদ্যোগ। সেক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে, এই তদন্তের পরে কার ব্যাংকে কি অর্থ পাওয়া গেলো, কার অর্থ সম্পদ কি তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা। কারণ যখনই বিএফআইইউ-এর মাধ্যমে ২৮ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে বলা হয়েছে এবং ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ধারণা সৃষ্টি হতেই পারে যে, এই সাংবাদিকরা হয়তো দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজ এবং এরা অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন করেছে। কিন্তু বিএফআইইউ যদি শেষ পর্যন্ত তদন্ত করে দেখে যে, এই সাংবাদিকদের আর্থিক হিসেব নিকেশ অত্যন্ত স্বচ্ছ। তাদের বিরুদ্ধে কোন দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত নয় এবং তাদের আয় ব্যয়ের হিসেবে কোন অসামঞ্জস্যতা নেই তাহলে এই রিপোর্ট প্রকাশের মাধ্যমেই সাংবাদিকদের ইমেজ ক্ষুন্নের পরিণত হতে পারে। সরকার যদি স্বচ্ছতার সাথে তদন্ত নিশ্চিত করে তাহলে উচিত হবে যেই সমস্ত তথ্যগুলো পাওয়া গেছে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা। অতীতেও আমরা দেখেছি বিভিন্ন সাংবাদিকের কাছ থেকে ব্যাংক হিসেবের এমন তথ্য চাওয়া হয়েছে কিন্তু পরবর্তীতে সেই হিসেব কি হলো সেটি আর প্রকাশ করা হয়নি। ফলে হিসেব চাওয়ার মাধ্যমে সাংবাদিকদের যে, সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন করা হলো তার কোন প্রতিকার হয়নি। স্রেফ স্বাধীন মত প্রকাশকে বাঁধাগ্রস্থ করার জন্য যেন এই উদ্যোগ না হয়। 

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে ২০ জন সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল হয়েছে এবং যে ২৮ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে কিংবা যেসকল সাংবাদিককে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে তারা সবাই আওয়ামী লীগের পক্ষের বলে অভিযোগ করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন চলমান ছিলো তখন বেশ কিছু গণমাধ্যম কর্মী কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে লিখেছেন। কেউ আবার বিরুদ্ধে অবস্থান লিখেছেন। যেকোন বিষয়ে ভিন্ন মত থাকতেই পারে। অনেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ভিন্ন ভাবে দেখতে পারেন। এখন প্রশ্ন হলো কোটা সংস্কার আন্দোলন বা রাজনীতি নিয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের কি ব্যক্তি চিন্তা বা ব্যক্তি মত থাকতে পারবে না? সবাইকে কি একটি মতের পক্ষেই হাটতে হবে? এমনকি তার ব্যক্তিগত মতকে ধামাচাপা দিয়ে শুধুমাত্র যে মত সরকার চায় সে মতেরই ধারক-বাহক হতে হবে? তাহলে আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে বর্তমান সরকারের পার্থক্য কি হলো। 

ভিন্ন মত একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অত্যন্ত স্বাভাবিক। আমি আমার মতামত প্রকাশ করবো। আমার মতামতের সঙ্গে সিংহভাগ জনতা একমত নাও হতে পারে। ভিন্ন মত এবং মতের দ্বন্দ্ব একটি সমাজকে বিকশিত করে। ভিন্নমত দমন করা কোন ভাবেই একটি সুস্থ সমাজের বৈশিষ্ঠ্য হতে পারে না। আমরা সম্প্রতি লক্ষ্য করেছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম একটি কলাম লিখেছেন। সেই কলামটিতে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করা হয়েছিলো এবং বঙ্গবন্ধুর অবদানের বিষয়ে তিনি তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু ঐ কলামটি লেখার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন মহল থেকে মাহফুজ আনামকে তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করা হয়। তাহলে কি আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতার কবর রচনা করবো? আমার মত কি আমি প্রকাশ করতে পারবো না? 

সাংবাদিকরা যদি ‘আওয়ামী লীগপন্থি’ হয়ে কোন অন্যায়-অনিয়মের সঙ্গে জড়ায় কিংবা কোন দুর্নীতি করেন বা পেশাদারিত্বের লঙ্ঘন করেন তাহলে তা অবশ্যই অন্যায়। অবশ্যই সেটির বিচার করতে হবে। কিন্তু শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের সমর্থক বা বঙ্গবন্ধুকে স্বীকার করে এই অপরাধে যদি কাউকে তদন্তের নামে হয়রানি করা হয় তাহলে সেটি দুর্ভাগ্যজনক। আমরা আশা করবো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যে তদন্ত হচ্ছে, সে মামলাগুলো প্রত্যেকটির রিপোর্ট যেন আলোর মুখ দেখে। সত্য জানার অধিকার সবার

 


Comments

Leave a Comment


Related Articles