Post Thumbnail

আহ্ প্রথম আলো! উহ্ ডেইলি স্টার!


গত সাড়ে ১৫ বছর প্রথম আলো আর ডেইলি স্টার ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদের প্ল্যাটফর্ম। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার মানে সরকারের সমালোচনা। সরকারের বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের প্রথম পাতায় স্থান পাওয়াটাই ছিলো নৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রথম আলো, স্বাধীন সাংবাদিকতায় বিশ্বাস করে বলে দাবী করে। আর এ কারণেই তৎকালীন সরকারের নানা সত্য মিথ্যা সমালোচনা মানুষ গোগ্রাসে গিলতো। প্রথম আলোর যে কোনও রিপোর্ট তা হোক অর্ধ সত্য কিংবা মিথ্যা, মানুষ ধারণা করত- এই রিপোর্টটি সত্য। প্রথম আলো-ডেইলি স্টারই যেন একমাত্র ‘বিরোধী দল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল আওয়ামী জনামায়। বিশেষ করে ২০১৮-এর পর থেকে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার-ই ছিল বিরোধী কণ্ঠস্বর। আর এ কারণে প্রথম আলো-ডেইলি স্টারকে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। ডেইলি স্টার এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম মুন্নী সাহার আয়োজিত একটি টকশোতে স্বীকার করেছিলেন এক এগারোর সময় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক পরিবেশিত তথ্য যাচাই বাছাই না করে তিনি তার সংবাদপত্রে পরিবেশন করেছিলেন। সেই কাজটা অন্যায় ছিল তাও তিনি কবুল করেন। ওই তথ্য ছিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। পরবর্তীতে এ জন্য তার বিরুদ্ধে সারাদেশে মামলা হয়। গণ মামলা নিয়ে তাকে বেশ হয়রানি পোহাতে হয়। যদিও এই মামলা ডেইলি স্টার এর ইমেজকে আরও বাড়ায়। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো এই ধরনের ঢালাও মামলার তীব্র সমালোচনা করে। ডেইলি স্টার আওয়ামী লীগ শাসনামলে এস আলম এর ‘আলাদিনের চেরাগ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন করে হইচই ফেলে দিয়েছিল। ডেইলি স্টারের এই সাহসিকতায় সুধীজন মুগ্ধ হয়েছিল। ডেইলি স্টার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে, গণভবনে নিষিদ্ধ ছিল। সরকারি অফিসগুলোতেও ডেইলি স্টার পারতপক্ষে রাখা হতো না। ডেইলি স্টারে সরকারি বিজ্ঞাপন দেয়াটাও অনেকে খারাপ চোখে দেখত। এই অবস্থানের কারণে ডেইলি স্টারের প্রচারে যেমন প্রসার ঘটেছিল, তেমনি ডেইলি স্টার নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করে, সৎ স্বাধীন সাংবাদিকতা করে- এমন এক ভাবমূর্তি তারা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। 

প্রথম আলোও গত সাড়ে ১৫ বছরে গণভবনে এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিষিদ্ধ ছিল। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদের প্রথম আলোর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার দুটি গণমাধ্যমই এক এগারোর কুশীলব হিসেবে পরিচিত এবং মাইনাস ফর্মুলার উদ্যোক্তা- এমন একটি ধারণা বাজারে প্রচলিত আছে। বিশেষ করে এক এগারোর সময় দুই নেত্রীকে সরে যেতে হবে- এরকম একটি সম্পাদকীয় লিখে আলোচিত সমালোচিত হন একদা কমিউনিস্ট নেতা মতিউর রহমান। সেই সূত্রেই প্রথম আলো সরকারের বিরুদ্ধে একটি শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে। প্রথম আলোর বিরুদ্ধেও সরকার ছিল সাঁড়াশি। বিশেষ করে সরকারি বিজ্ঞাপন কমিয়ে দেয়া, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেন প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন না দেয়, সেজন্য প্রত্যক্ষ পরোক্ষ নির্দেশনা প্রদানের অভিযোগ ছিল সরকারের বিরুদ্ধে। এছাড়াও সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার দাওয়াত পেত না। প্রথম আলোর একজন সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি তথ্য সংগ্রহ করতে যেয়ে ‘ফাইল চুরি’র অপরাধে আটক হন। পরবর্তীতে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং জেলে যেতে হয়। এ নিয়ে চলে হইচই। তার (রোজিনা ইসলাম) গ্রেফতারের বিরুদ্ধে সকল সংবাদকর্মীরা একাট্টা হয়েছিল। এইভাবে প্রথম আলো যেন সরকারের বিরুদ্ধে একমাত্র প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পেছনে যে প্রতিষ্ঠানগুলোর সবচেয়ে অবদান রয়েছে বলে ধারণা করা হয়, তার মধ্যে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার অন্যতম। বিশেষ করে এই সময় সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা, ছাত্রদের আন্দোলনকে সরাসরি সমর্থন দেয়া সহ সরকারের বিরুদ্ধে একটি জনমত সৃষ্টিতে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট নতুন সরকার গঠিত হয়। এই নতুন সরকারে যারা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান তাদের বেশির ভাগই প্রথম আলোর কলামিস্ট হিসেবে পরিচিত। প্রথম আলোর সঙ্গে তাদের একটা গভীর সম্পর্কের কথা সকলেই জানে। বিশেষ করে ড. আসিফ নজরুল, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আলী ইমাম মজুমদার সহ একাধিক উপদেষ্টা প্রথম আলো পরিবারের সদস্য হিসেবে বিবেচিত। পরবর্তীতে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর অন্তর্ভুক্তি প্রথম আলোর ক্ষমতা বলয়কে আরও পোক্ত করে। নতুন সরকারকে সমর্থন দেয়ার ক্ষেত্রেও প্রথম আলো কুণ্ঠাবোধ করেনি, বরং বর্তমান সরকারের দুর্বলতা বা সমালোচনা গুলোকে এড়িয়ে আওয়ামী লীগের সমালোচনা এবং নতুন সরকারের বন্দনায় মুখর ছিল প্রথম আলো- ডেইলি স্টার। অনেকেই প্রথম আলো-ডেইলি স্টারকে বর্তমান সরকারের অংশও মনে করেন। কিন্তু সেই প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার এখন এক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি। প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের অস্তিত্ব এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে। আর এই চ্যালেঞ্জের কারণ হলো আন্দোলনের (ছাত্র-জনতার আন্দোলন) উগ্রবাদী অংশ, যারা এই আন্দোলনে আসলে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়, তারা প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারকে ভারতীয় আগ্রাসনের প্রতিভূ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রথম আলোর নাম দিয়েছে তারা ‘দিল্লী আলো’, আর ডেইলি স্টারের নাম দিয়েছে তারা ‘দিল্লী স্টার’। 

গত বৃহস্পতিবার থেকে এই দুটি গণমাধ্যম অফিসে থেমে থেমে নানা রকম কর্মসূচি দিচ্ছে একটি নির্দিষ্ট জনতা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিমধ্যেই প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করা হয়েছে। গতকাল রোববার বিকাল থেকে প্রথম আলোর সামনে যে ঘটনা ঘটেছে তা উদ্বেগজনক। বিশেষ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশকে কাঁদুনে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে হয়েছে। কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে ঘটনাস্থল থেকে। এটি সামনে যে আরও খারাপ দিকে মোড় নেবে সেটা বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে এই আন্দোলনের সঙ্গে যে সমস্ত উগ্র, ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তি জড়িত ছিল, তারা এখন প্রথম আলো-ডেইলি স্টারকে এতো সহজে ছেড়ে দেবে না। প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের বর্জনের ডাকে ইতিমধ্যে দুটি পত্রিকারই পাঠক সংখ্যা ও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। 

বিগত সরকারের আমলে প্রথম আলো নির্বিঘ্নে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করতে পারত। এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে একাধিক লেখা প্রকাশিত হতো। প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় মানেই ছিল সরকারের কঠোর সমালোচনা। সেই সমালোচনা গুলো আওয়ামী লীগ সরকার হজম করতো। অন্তত আওয়ামী লীগের এইটুকু সহনশীলতা ছিল। কিন্তু এখন ৫ আগস্ট আন্দোলনে যারা উগ্রবাদী গোষ্ঠী তাদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ উচ্চারণ করার সাহস প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের নেই। বরং তারা নীরবে নিভৃতে এটি হজম করছে। তারা প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের অভ্যন্তরে শুধু আহ্ এবং উহ্ উচ্চারণ করা ছাড়া পত্রিকার পাতায় তাদের সমালোচনা করার ন্যূনতম সাহসটুকু নেই। এখানেই হল পার্থক্য। আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক অনিয়ম ছিল, অনেক দুর্নীতি ছিল। প্রথম আলো-ডেইলি স্টার মন খুলে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করতে পেরেছে। গত ১৫ বছরে এমন কোনও দিন নেই, যেদিন প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে সরকারের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবেদন বা সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়নি। এমনকি বর্তমান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এই সময় প্রথম আলোতে যে ধরনের কলামগুলো তা এখন ভাবলেও গা শিউরে ওঠে। বর্তমান সরকারকে সমালোচনা করে এ ধরনের কলাম লেখা তো দূরের কথা, একটি লাইন লেখার সৎ সাহস কারও আছে কিনা আমার জানা নেই। প্রথম আলো-ডেইলি স্টার এখন না পারছে ফেলতে না পারছে গিলতে।

৫ আগস্টের আন্দোলনে অনেকগুলো ক্রিয়াশীল শক্তিই ছিল। এই আন্দোলনের সঙ্গে অনেকেই যুক্ত ছিলেন নানা ভাবে। ইসলামী ছাত্রশিবির, হিজবুত তাহরীর, এবি পার্টি, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী সহ একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠী এই আন্দোলনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তারাই এখন প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। এখন গত কয়েক দিনে প্রতিবাদীদের উপস্থিতি কম। কিন্তু এই উপস্থিতি সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়তে থাকবে। যখনই উপস্থিতি বাড়বে তখন প্রথম আলো-ডেইলি স্টার কি করবে? আগে তো আওয়ামী লীগের সমালোচনা করতে পারতো, আওয়ামী লীগ সরকারকে গালাগালি করতে পারতো। এখন প্রথম আলো কি করবে? শুধু আহ্ উহ্ করবে নাকি প্রথম আলোকে সাধারণ মানুষ বলবে আহ্ প্রথম আলো! উহ্ ডেইলি স্টার!


Comments

Leave a Comment


Related Articles