রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যালয়ের চিত্র বদল
শান্ত সিংহ: ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছে। দায়িত্ব নিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার। পরিবর্তন হয়েছে দেশের রাজনৈতিক চিত্রেরও। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ইতোমধ্যে প্রায় তিন মাস হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে রাজনৈতিক কী পরিবর্তন এসেছে বিশেষ করে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় কার্যালয়গুলোর চিত্র এখন কেমন তা দেখার বেশ আগ্রহ জাগে মনে। এই আগ্রহ থেকেই দলগুলোর কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঘুরে দেখা। চলুন দেখা যাক কেমন দেখলাম তাদের রাজনৈতিক অফিসগুলোর এখনকার চিত্র।
পরিবর্তন নেই নয়াপল্টনের পার্টি অফিসের
নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ছবি।
৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ধানমন্ডি ৩ নম্বরে সভানেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ের চিত্র কেমন তা সবার জানা। তাই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু নয়াপল্টনস্থ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। আলোচনা রয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি হলো বিএনপি। কারণ দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর ধরে দলটি সরকার পতনের আন্দোলন করে আসছে। একাধিক সরকার পতনের আল্টিমেটাম ঘোষণা করলেও বারবার দলটি ব্যর্থ হয়েছে। এবার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন হওয়ায় রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দলটির পথ প্রশস্ত হয়েছে। তাই দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী সেটি একটি কৌতুহলের বিষয়। এর আগে অসংখ্যবার এখানে আসা যাওয়া হয়েছে। ৫ আগস্টের পরও দলটির পার্টি অফিসের সামনে দিয়ে আসা যাওয়া করা হয়েছে বৈকি তবে সেভাবে পরিস্থিতি দেখার সুযোগ হয়নি। আজ এসেছি ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর এখন কার্যালয়টির অবস্থা দেখতে। দিনটি ছিলো শনিবার সন্ধ্যা বেলা। কার্যালয়ের সামনে দাঁড়াতেই একটু অবাক হতে হয়। কারণ পরিস্থিতি প্রত্যাশিত নয়। ধারণা করেছিলাম অনেক নেতাকর্মীর উপস্থিতি থাকবে, এলাকাটি বিএনপির নেতাকর্মী দ্বারা লোকে লোকারণ্য থাকবে। কিন্তু তেমনটি চোখে পড়েনি। প্রত্যাশার চেয়ে নেতাকর্মীর উপস্থিতি ছিলো নগণ্য। কার্যালয়ের বড় কলাপসিবল গেট ছিলো বন্ধ। তবে পাশের পকেট গেট খোলা ছিলো। নেতাকর্মীরা ভেতরে যাওয়া-আসা করছেন। তবে কার্যালয়ের সামনে এবং হোটেল ভিক্টরির গলিতে তেমন লোকারণ্য চোখে পড়েনি। হোটেল ভিক্টরির সামনে আগে যেখানে সবসময় একটি পুলিশ দল থাকতো সেখানে পুলিশের কোন উপস্থিতিই মিললো না। কেন এতো কম সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি জানতে চাইলে উপস্থিত দু একজনের সঙ্গে কথা বললে তারা শনিবার সরকারি ছুটির দিনের কথা উল্লেখ্য করেন।
এখনো পুরোপুরি ভাবে মুখরিত নয় মগবাজারের পার্টি অফিস
রাজধানীর মগবাজারে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মূল ফটকের ছবি।
দীর্ঘ ১৪ বছর পর গত ৫ আগস্ট রাতে খুলেছে মগবাজারস্থ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়। তবে এখনো পুরোপুরি ভাবে মুখরিত হয়ে উঠেনি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা এই পার্টি অফিস। সরজমিনে পার্টি অফিসের সামনে গিয়ে দেখা গেল খুব পরিপাটি চেহারা। মূল গেট এবং দেওয়ালে নতুন রং। অনুমান করা যায় ভবনটি নতুন রূপে সাজছে। মূল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ভেতরে ঢুকতে দেখা গেল দুজন যুবক ফুলের টব ঘষামাজা করছেন, সেগুলো সারিবদ্ধ করে সাজাচ্ছেন। আরেকটু ভেতরে ঢুকে পাওয়া গেল অভ্যর্থনা কক্ষ। কথা হলো অভ্যর্থনাকারীর সঙ্গে। জানতে চাইলাম পার্টি অফিসের বর্তমান হালছাল। তিনি জানালেন এখনো সেভাবে জমে উঠেনি পার্টি অফিসের কার্যক্রম। তবে মাঠ পর্যায়ে দলীয় কার্যক্রম সক্রিয় রয়েছে। আমির নিয়মিত মফস্বলের বিভিন্ন দলীয় প্রোগ্রামে উপস্থিত হচ্ছেন। তিনি আরও জানান, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান সহ দলের অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতারা আসছেন ঠিকই তবে এখনো কার্যালয়ে সেভাবে থাকেন না তারা। কারণ হিসেবে তিনি জানালেন তাদের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষগুলো পরিপূর্ণ ভাবে প্রস্তুত করা হয়নি। তবে দলীয় প্রোগ্রাম সহ অন্যান্য সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে চলছে।
জনশূন্য জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়
রমনায় জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ছবি।
আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে ছাত্র-জনতার আঙ্গুল জাতীয় পার্টির দিকে। ফলে সঙ্গত কারণেই আগ্রহ জাগে দলটির পার্টির অফিসের চিত্র প্রত্যক্ষ করতে। রমনাস্থ দলটির পার্টি অফিসে সরেজমিনে দেখা যায় শুধু ভবন নয়, ভবনের আশপাশ এলাকাও যেন জনশূন্য! শনিবার সরকারি ছুটির দিন হওয়ার কারণে এমনটি হতে পারে। তবে পার্টি অফিস ছিলো বন্ধ। মূল ফটকের সামনে তিনজন ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখা গেলে তারা জানান যে, তারা কেউই জাতীয় পার্টির সমর্থক কিংবা পার্টির অফিসের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীও নন। কার্যালয়ের সামনের চিত্রও অন্ধকার। কোন আলো জ্বলছে না সেখানে।
ধ্বংসস্তুপের সাক্ষী ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র্রীয় কার্যালয়ের ছবি।
২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আওয়ামী লীগের কেন্দ্র্রীয় কার্যালয়। রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা। সড়কের দুপাশে মানুষের যাওয়া আসা আছে। তবে প্রায় তিন মাসের আগের মতো নয়। এই পার্টি অফিসে আগেও অনেকবার এসেছি। পুরো সড়ক রাত অবদি লোকে লোকারণ্য থাকতো। বিভিন্ন দামি ব্র্যান্ডের গাড়ির পার্কিং থাকতো এই সড়কের দুপাশ। একদল পুলিশের উপস্থিতি থাকতো সারাক্ষণ। কিন্তু আজ এগুলোর কোনটাই নেই। শুধুমাত্র পোড়া ভবন ছাড়া। কয়েকটা গাড়ি পার্কিং করা থাকলেও সেগুলো যে সাধারণ মানুষের সেটা বলাই বাহুল্য। ভবনের সেই ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নাম ফলকটিও এখন আর নেই। সেখানে লাল রংয়ে লেখা হয়েছে ছাত্র-জনতার অফিস। ভবনের নিচ থেকে একেবারের ওপর পর্যন্ত পুরোটাই পোড়ার চিহ্ন। কোথাও কোথাও এখনো ছাইয়ের স্তুপ পড়ে আছে। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশেই বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। সেখানেও একই চিত্র। শুধু পোড়া ভবনের অস্তিত্ব। ঠিক বিপরীত দিকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কার্যালয়। একই চিত্র সেই ভবনেরও। এই ভবনের নিচে মার্কেট থাকার কারণে ভবনের সামনে এবং আশেপাশে কিছু মানুষকে দেখা যায়। তাদের কেউ দোকান বন্ধ করে বাসায় ফেরার প্রস্তৃতি নিচ্ছেন, কেউবা শপিং করে ঘরে ফিরছেন।
নিস্তব্ধ ধানমন্ডি ৩-এর পার্টি অফিস
ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ের ছবি।
ধানমন্ডির ৩/এ সড়কের ৫১ নম্বর বাড়ি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়। সকাল সন্ধ্যা আনা-গোনা থাকতো বিভিন্ন নেতাকর্মীর। কখনো দলের সাধারণ সম্পাদকের সংবাদ সন্মেলন, কিংবা রাজনৈতিক আড্ডায় মুখরিত থাকতো এই কার্যালয়। তবে ৫ আগস্টের পর পুরো চিত্র পাল্টে গেছে। পোড়া ভবন ছাড়া আর কোনকিছুর অস্তিত্ব নেই সেখানে। সরেজমিনে দেখা যায় মূল ফটকের সামনে একটি বাস দাঁড় করানো। এছাড়া দুটি অস্থায়ী দোকান এবং ভবনের সামনে পুরো সড়কটি অন্ধকারাচ্ছন্ন এক নিস্তব্ধ পরিবেশ।
Comments
Leave a Comment