তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ...
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন সাধু সন্ন্যাসীদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। রাজনীতিতে ‘অমর বাণী’ দেয়ার লোকের অভাব নেই ইদানিং। সবাই সুন্দর সুন্দর কথা বলছেন। এমন কথা বলছেন যে, তারা যেন সাক্ষাৎ দেবদূত। জামায়াতের আমির সম্প্রতি বলেছেন যে, জামায়াত একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেনি। এ যেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে এ যাবৎকালের সেরা আবিষ্কার! এই কথা শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের সাথে এ নিয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ‘চমকে উঠার কি আছে! জামায়াত যে এখনও বলেনি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে তারাই নেতৃত্ব দিয়েছিল, এটাই তো তাদের উদারতা, মহত্ত্ব। কদিন পরে এমন দাবী করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’ বাংলাদেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন করে চর্চা দৃশ্যমান। নতুন নতুন ইতিহাসবিদ পয়দা হয়েছেন। তাদের বয়ানে মুক্তিযুদ্ধের নানা ব্যাখ্যায় জাতি এখন দিশেহারা। কাজেই নতুন ইতিহাসে জামায়াত যদি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার দাবি করে থাকে সেই দাবি কতটা অমূলক হবে? আর সেই দাবিকে অস্বীকার করার মত কোমড়ে জোর কজনের আছে?
ইদানিং ‘ভাসানী চর্চা’ শুরু হয়েছে মহামারী আকারে। মাওলানা ভাসানী বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব তা অস্বীকার করার কোন কারণ নেই। কিন্তু যেভাবে মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে মাতম উঠেছে, তাতে আমার আবার ভয় লাগছে। কোন দিন না তাকেই ‘জাতির পিতা’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। দল বেঁধে লোকজন মাওলানা ভাসানীর করব জিয়ারত করছেন। উপদেষ্টার পরিষদের বহর রীতিমতো টাঙ্গাইলে ভিড় করছেন। সাথে আছেন চিন্তক তাত্ত্বিক। মাওলানা ভাসানীকে মহিমান্বিত করা নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু মাওলানা ভাসানীকে বড় করা হচ্ছে কাউকে ছোট করার জন্য। এই মতলবী ‘প্রেম-শ্রদ্ধা’ ভয়ংকর। ইতিহাসে যার যার স্থান নির্ধারিত। কাউকে বড় করে কাউকে ছোট করা যায় না। কিন্তু তারপরও মাওলানা ভাসানীকে বড় করে ইতিহাস নতুন ভাবে লেখার চেষ্টাই শুধু চলছে না, কোন কোন মহল চেষ্টা করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে যতটা খাটো বানানো যায়। বঙ্গবন্ধু যেন গজ কাপড়! কেটে দিলেই, ছেঁটে দিলেই ছোট হয়ে যাবে। বাস্তবতা উপলব্ধির বোধ আমাদের কবে হবে জানি না।
অন্যদিকে বিরোধী দল এই আন্দোলনের পর এখন ক্ষমতার ঘ্রাণ পাচ্ছে। তারাও নিত্য নতুন সুন্দর কথা বলছেন। গণতন্ত্র নিয়ে তাদের অমৃত বাণী গুলো শুনে জাতি মুগ্ধ। যদিও তাদের কথা এবং কাজের মধ্যে দুস্তর ফারাক। সম্প্রতি বিএনপির পক্ষ থেকে ৩১ দফা রাষ্ট্র কাঠামো বিনির্মাণের সুপারিশ পেশ করা হয়েছে। এই সুপারিশে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলা হয়েছে। কেউ যেন দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হতে পারে, এমনকি পরিবারতন্ত্রকেও প্রশ্রয় না দেয়ার কথা বলা হয়েছে। পুরো ৩১ দফা পড়ে নিজের অজান্তেই হেঁচকি উঠল। তাহলে এত দিন বিএনপি কি করেছিল? ১৯৯১ সালে যখন বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু করে তখন বিএনপি ক্ষমতায়। বিএনপির নেতৃত্বেই দ্বাদশ সংশোধনী বিল সংসদে পাশ হয়েছিল। সেখানে প্রধানমন্ত্রী হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। তৎকালীন সময় অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান রাষ্ট্রপতিকে ‘বাটকু’ বলেও অভিহিত করেছিলেন, যা ড. আকবর আলির খানের গ্রন্থে পাওয়া যায়। রাষ্ট্রপতিকে অসম্মান করা, শুধুমাত্র কবর জিয়ারত করা রাষ্ট্রপতি বানানোর ‘মাস্টার মাইন্ড’ তো ছিল বিএনপি (মাস্টার মাইন্ড কথাটি এখন খুব জনপ্রিয়, এজন্য শব্দটি ব্যবহার করার লোভ সামলাতে পারলাম না)। এখন যদি বলা হয় যে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা বন্ধ করা হবে, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করতে হবে, তাহলে তো ভাল কথা। কিন্তু নিজের অজান্তেই জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে, এত দিন কোথায় ছিলেন? ১৯৯১, ২০০১ সালে এই বোধ গুলো কোথায় ছিল?
নব্বই গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের সামনে একটা অভাবনীয় সুযোগ এসেছিল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে স্থায়ী রূপ দেয়া লক্ষ্যে তিন জোটের রূপরেখা তৈরি করেছিল সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ ভাবে। ১৯৯০ সালে ১৯ নভেম্বর এই তিন জোটের রূপরেখা যৌথভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। সেখানে অনেক মিষ্টি মিষ্টি কথা ছিল। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর কতটুকু, কি করা হয়েছে তার সাক্ষী ইতিহাস। বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের সমালোচনায় মুখর। আওয়ামী লীগের সমালোচনা করার যৌক্তিক অধিকার তাদের নিশ্চয় আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সমালোচনার পাশাপাশি তারা যদি আয়নায় নিজেদের চেহারাটা দেখত, তাহলে হয়ত কথাগুলো এত মিষ্টি মধুর হত না। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের এই অগ্রযাত্রার জন্য আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু দলই যে দায়ী, সে কথা কে বলবে?
বাংলাদেশে কেন কর্তৃত্ববাদী শাসনের উদ্ভব হল? কেন স্বৈরাচারী ব্যবস্থা জগদ্দল পাথরের মতো আমাদের বুকের উপর এসে বসলো সেটির হিসেব করতে গেল আমাদের অতীতে ফিরে যেত হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হল কেন?- সেই প্রশ্নে উত্তর যদি আমরা খুঁজি তাহলে দেখবো ২০০১ সালে নির্বাচনের পর কিভাবে সংবিধানকে দলীয় স্বার্থে সংশোধন করা হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে একান্ত অনুগত রাখার জন্য প্রধান বিচারপতির বয়সসীমা বাড়িয়ে সংবিধান সংশোধন করেছিল বিএনপি। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ নিজেই তার গ্রন্থে স্বীকার করেছেন, এটি অন্যায় ছিল। এরপর ২০০৬ সালের অক্টোবরে যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল, তা ছিল ক্ষমতা আঁকড়ে রেখে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের এক হিংস্র প্রচেষ্টা। আর সেই প্রচেষ্টার কারণে জীবন দিতে হয়েছিল বহু মানুষকে। গণতন্ত্র নির্বাসনে গিয়েছিল, এসেছিল এক এগারো সরকার। ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করা হয়েছিল? কেন সেই সময় সকল রাজনৈতিক দলগুলো মিলেমিশে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে পারেনি? কেন ‘আজিজ মার্কা’ নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল? সেই প্রশ্নের উত্তরগুলো বিএনপি কেন কখনোই দেয় না? বিএনপি এখন অনেক ভালো ভালো কথা বলছে। কিন্তু অতীতের জন্য একবারেও দুঃখ প্রকাশ করেনি। যেমন অতীতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেনি জামায়াত।
একাত্তর সালে জামায়াত কি করেছে, না করেছে তা জামায়াতের গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রিসভায় জামায়াতের দুইজন সদস্য অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। জামায়াত শুধুমাত্র যে একাত্তরে গণহত্যার মদদদাতা ছিল তাই নয়, জামায়াত গণহত্যার সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিল। আজ যদি জামায়াত বলে যে তারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেনি, তাহলে পুরো জাতিকে লজ্জিত হতে হবে। এ নিয়ে কোন কথাবার্তা নেই ৫৩ বছরের ইতিহাসে যে সবচেয়ে স্বাধীন গণমাধ্যমে। গণমাধ্যম স্বাধীন এই কথা এখন ভেঁপুর মতো সকাল সন্ধ্যা বাজানো হচ্ছে। একই কথা আমরা শুনেছি আওয়ামী লীগ আর বিএনপির আমলেও। বাংলাদেশে যদি গণমাধ্যম এতই স্বাধীন তাহলে এতগুলো সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল হল কেন? এত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হচ্ছেই বা কেন? সেসব প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। এক সময় বাংলাদেশে ‘সুশীল সাংবাদিক’ ছিলেন, যারা আওয়ামী পন্থি সাংবাদিকদের দেখে নাক সিঁটকাতেন, সাংবাদিকরা কেন দলীয় লেজুড় হয়ে যাচ্ছে বলে রীতিমত বমি করতেন, এখন সেই সাংবাদিকরাই দেখি বিদেশের বিভিন্ন মিশনে চাকরি জন্য দেনদরবার করছেন। তারা যখন একটা সরকারকে চোখ কান বুজে নির্লজ্জভাবে সর্মথন দিচ্ছেন তখন তাকে কি বলব? তারা অন্ধের মতো কাউকে সমর্থন দিলে দলকানা হয়না? সুশীল সাংবাদিক বলে কথা! এক দেশে যেন দুইটি নীতির উপর চলছে। যখন আপনি সুশীলদের সমর্থন করবেন, সুশীলদের জন্য অন্ধ লেজুড় বৃত্তি করবেন, সুশীলদের পদলেহন করে আপনি এটা ওটা বাগাবেন তখন সেটি কোন অপরাধ নয়। আপনি মহান। যখন আপনি কোন দলীয় সরকারকে নীতিগত ভাবে বা আদর্শিক ভাবে সমর্থন দিবেন তখন সেটি হবে সাংবাদিকতার রীতি বিরুদ্ধ। তখন আপনি দলীয় লেজুড়, দলকানা।
বাংলাদেশের মিডিয়া যখন যার, তখন তার। কদিন আগে যে সমস্ত মিডিয়া শেখ হাসিনা ছাড়া কিছুই বুঝতো না, শেখ হাসিনাকে আজীবন ক্ষমতায় রাখার জন্য জীবন উৎসর্গ করার ঘোষণা দিত, প্রতিদিন শেখ হাসিনা এবং তার সরকারকে তৈলমর্দনের প্রতিযোগিতা দেখা যেত, তারা এখন শেখ হাসিনা শব্দটি উচ্চারণ করে না। হাসিনার আগে ফ্যাসিস্ট শব্দ ব্যবহার করে তাদের যেন তৃপ্তি হয়। এই সমস্ত মিডিয়াতে আবার আগের মতো সত্য মিথ্যা দুর্নীতির গল্প ফাঁদা হচ্ছে। আগে লেখা হতো বিএনপির বিরুদ্ধে, এখন লেখা হয় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। আগে শুনতাম হাওয়া ভবনের লুণ্ঠনের গল্প। বিএনপি নেতাদের হাজার কোটি টাকা পাচারের থ্রিলার পত্রিকার পাতায় দেখে গা শিউরে উঠতো। এখন একই গল্প। শুধু বিএনপি নেতার বদলে আওয়ামী লীগ নেতার নাম বসান। এই গল্প সত্য, না মিথ্যা কে তা যাচাই করবে? যাদেরকে দোষী বলা হচ্ছে তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোন সুযোগ নেই। এটি কি ধরনের সাংবাদিকতা, সেই প্রশ্ন করার মতো কেউ নেই!
বাংলাদেশে সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতা হল যখন যাদের কাছে ক্ষমতায় থাকে, তখন তারা সাধু হয়ে যান। তারা সবকিছুই ঠিকঠাক আছে বলে মনে করেন এবং সেটি সবাইকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেন। আর কর্পোরেট ক্রীতদাস মিডিয়া সেই বক্তব্যকে যৌক্তিক বলে রীতিমতো প্রচারের প্রতিযোগিতা করে। তারপর যখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়, তখন তারাই আবার শুরু করে সমালোচনা। সেটিও আবার অপরপক্ষকে খুশি করার জন্য। এই মিডিয়া যে কতটা দেউলিয়া তা ৫ আগস্টের আগে এবং পরে কয়েকটি পত্রিকা ঘাটলেই পাওয়া যাবে। তবে সবকিছু মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল যে, কোন নির্ভেজাল সত্য আমাদের সামনে আসছে না। কেউ অকপটে নিজেদের দোষ ত্রুটি স্বীকার করছে না। একটি রাজনৈতিক দলের ভালো-মন্দ থাকবে। কিন্তু যখন একটি রাজনৈতিক দল বলে যে, আমরাই সব, আমরাই ভালো, আমরাই সবকিছু করেছি তখনই ফ্যাসিবাদের বীজ অঙ্কুরিত হয়। তখন রবী ঠাকুরের মতো শুধু বলতে ইচ্ছে করে- ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।’
Comments
king khan
2 months agoঅসাধারণ বিশ্লেষণ।
Afsana Kishwar
2 months agoএ এক আজব কুদরতি
Leave a Comment