পথ হারিয়েছে বাংলাদেশ?
৫ আগস্টের পর দেশের মানুষ প্রত্যাশা করেছিল দ্রুত স্বস্তি ফিরে আসবে। স্বাভাবিক কর্মকান্ডে সচল হবে দেশ। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় ৫ মাস হতে চললো। অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত বাংলাদেশ। আগামীকাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শহীদ মিনারে সমাবেশ ডেকেছে। সেখানে ঘোষিত হবে নতুন ঘোষণাপত্র। এটা কি দেশকে আবার নতুন করে বিভক্তির পথে নিয়ে যাবে? দেশ কোন পথে যাচ্ছে? এসব নানা প্রশ্ন এখন জনমনে।
২৫ ডিসেম্বর ছিলো বড়দিনের ছুটি। অফিস আদালত সব বন্ধ। এর মধ্যেই গভীর রাতে সচিবালয়ের মতো স্পর্শকাতর এলাকায় আগুন লাগলো। ২৬ ডিসেম্বর সপ্তাহের শেষ কর্ম দিবসে সরকারী কর্মচারীরা আতংকে তাকিয়ে থাকলো আগুনের ধ্বংসস্তূপের দিকে। এই ঘটনার কোন কূলকিনারা হয়নি এখনো। এ ঘটনার জেরে সচিবালয়ে সাংবাদিক প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার ঘটনায় জন্ম দিয়েছে নতুন বিতর্ক। গত ২২ ডিসেম্বর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই কানুকে জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করা হয়। এই ঘটনায় হতবাক গোটা দেশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার জুতা পরানোর দৃশ্য বহু মানুষকে কাঁদিয়েছে। সোমবার বিকেলে মেঘনা নদীতে নোঙ্গর করা সারবাহী এক জাহাজ থেকে রক্তাক্ত সাতজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সোমবার লক্ষ্মীপুরে এক নারীকে পেটানোর ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে। এ ধরনের ঘটনা এখন ঘটছে প্রতিদিন। কোথাও শান্তি নেই, নেই স্বস্তি। অজানা আশঙ্কায় যেন পুরো দেশ। আগামীকাল কী হবে?—কেউ জানে না। হঠাৎ করে রাস্তাঘাট অবরুদ্ধ করে দাবিদাওয়া আদায় করার মহড়া চলছে প্রায় প্রতিদিন। পুলিশ নিস্ক্রিয়। খুন রাহাজানি, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা এখন যেন স্বাভাবিক। জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবন দিশেহারা। ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যারা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তারা এখন হতাশ। সামনের দিনগুলোতে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে সেই চিন্তায় অনেকেই উৎকণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশ কী পথ হারিয়েছে?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ প্রায় পাঁচ মাস শেষ হতে চলল। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই সরকার দেশে স্বাভাবিক অবস্থা তো ফিরিয়ে আনতেই পারেনি, বরং নিত্য নতুন সমস্যাকে যেন নিজেরাই আলিঙ্গন করছে। প্রশাসনের মধ্যে প্রথম দিকে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল। তরুণ মেধাবীরা বৈষম্যহীন প্রশাসনে কাজ করার জন্য ছিলেন প্রস্তুত। বেশ কিছু অতি উৎসাহী চাটুকার এবং আমলাদেরকে অবসরে পাঠানোর পর তরুণ মেধাবীরা আশা করেছিলেন যে, এবার তাদের উপর দায়িত্ব আসবে। যোগ্যতার ভিত্তিতে তারা হয়তো পদোন্নতি পাবেন। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি। ১২ বছর আগে অবসর নেওয়া ব্যক্তিদেরকে ডেকে ডেকে সচিব পদে দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ পদবী গুলো সবই চুক্তির দখলে চলে যাচ্ছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের এক বাম্পার ফলন যেন সারা প্রশাসনকে গ্রাস করে ফেলেছে। এর মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনপ্রশাসন সংস্কারের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে হাত দিয়েছে। যা একটি নির্বাচিত সরকারের কাজ। এই অপ্রয়োজনীয় কাজ করতে গিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশাসনকেই অস্থির করে ফেলেছে। আন্ত:ক্যাডার দ্বন্দ্বে অচল প্রায় প্রশাসন।
চিকিৎসকরাও দাবিদাওয়া নিয়ে রাস্তায়। ঢাকা শহরে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটছে। এক সময় ঢাকা শহরের নাম ছিল ‘মসজিদের শহর’। পরে অনেকেই ঢাকা শহরকে ‘যানজটের শহর’ বলেন। এখন হয়ে গেছে ‘অবরোধের শহর’। আপনি ঘর থেকে বেরোবেন, কোথায় কখন কোন দাবিতে অবরোধ হবে আপনি জানেন না। আপনাকে ভয়াবহ বিপদের মধ্যে পরতে হবে। ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প সব স্থবির হয়ে আছে। কোনও ব্যবসায়ী, শিল্পপতি কোনও নতুন উদ্যোগে হাত দিচ্ছেন না। শিল্পপতি ব্যবসায়ীদেরকে করা হচ্ছে নানারকম ভাবে হয়রানি। শিল্প কারখানা গুলোতে হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনার বিচার হয়নি। দুর্নীতি দমনের নামে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা হচ্ছে। ফলে শিল্প উদ্যোক্তারা চরম নিরাপত্তাহীনতায় হাত পা গুটিয়ে বসে আছেন। চালের বাজারে অস্থিরতা। অর্থনীতিতে আজ মহা বিপদ সংকেত।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সহনশীলতার অভাব ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। সমালোচনা সহ্যের মানসিকতা নেই অনেকের। তারা যা করছে, সেটাই সঠিক-এরকম ভাবনা সরকারের কারও কারও মধ্যে। আওয়ামী লীগের সময় মামলা বাণিজ্য ছিল রমরমা। ঠিক তেমনি এখন মামলা বাণিজ্য সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। ঢালাওভাবে হত্যা মামলা দিয়ে বিচারকেই একটা প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। যেখানে যে পারছে মামলা দিচ্ছে। পরে চলছে নাম বাদ দেয়ার নামে চাঁদাাবাজি। বাদী জানেনা মামলা হয়েছে। আসামি চেনেন না বাদীকে। রাজনীতিবিদ থেকে ব্যবসায়ী, সাংবাদিক থেকে শুরু করে সাধারণ চাকুরে, সবাই হত্যা মামলার আসামী। সারাদেশে এরকম মামলার হয়রানির শিকার কয়েক লাখ মানুষ। মৃত ব্যক্তিও সরকারের ভেতর ‘বাঁচাল’ লোকজনের সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে বেসামাল কথাবার্তা। আওয়ামী লীগ আমলে যেমন কিছু বাঁচালের কথার অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ছিল, এখন তেমন কোনও কোনও ব্যক্তি এমন সব উদ্ভট কথা বলছেন যে, মানুষ হাসবে না কাঁদবে ভেবে পাচ্ছে না। সরকারের কেউ কেউ টেলিভিশনে চেহারা না দেখালে যেন পাগল হয়ে যান। বেসামাল কথাবার্তায় মানুষের কান ঝালাপালা। এই পরিস্থিতিতে দেশ আসলে কে চালাচ্ছে—সেটি নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সিংহাসনের পিছনে আসলে কার ছায়া? কার ইশারায়, কার ইঙ্গিতে দেশ পরিচালিত হচ্ছে? মানুষ ইদানিং রসিকতা করে বলেন, দেশ আসলে কেউই চালাচ্ছেন না, দেশ চলছেই না। সচিবালয়ে কোনও কাজ হচ্ছে না, স্থবির। থানায় মামলা দিলে, সেই মামলার তদন্ত হচ্ছে না। চিকিৎসকরা ঠিকঠাক মতো চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন না। ব্যবসায়ীরা নিরাপদে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পারছেন না। শুধুমাত্র আছে হমকি ধামকি এবং দম্ভোক্তি। বাংলাদেশ যেন এখন একটা পথহারা দেশ। এই দেশের গন্তব্য কোথায় কেউ জানে না।
দেশ এক গভীর সংকটে, তা কেউ অস্বীকার করছে না। এরকম পরিস্থিতিতে করণীয় কী? সকলেই এখন মোটামুটি একমত যে, একমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমেই এই সরকারের ‘সেফ এক্সিট’ হতে পারে। একটি নতুন নির্বাচিত সরকারের দায়িত্বগ্রহণের মাধ্যমেই বর্তমান অচলাবস্থার অবসান ঘটতে পারে। দেশ একটি সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে যেতে পারে। পথহারা বাংলাদেশ পথের ঠিকানা খুঁজে পেতে পারে। এই সরকার ৫ আগস্ট যে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলো এখন তার জনপ্রিয়তা তলানিতে। দিন যতই যাবে এই জনপ্রিয়তা কমতেই থাকবে। এ কারণে সরকারকে দ্রুত নির্বাচনের পথে যাওয়া উচিত। কিন্তু সরকার নানা রকম সংস্কার কমিশন করে কালক্ষেপন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের অনেকেই বলেছেন সংস্কার শেষ করে নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু এসব কথা জনআকাঙ্খার পরিপন্থি। এসব সংস্কারের ব্যাপারের জনগণের ম্যান্ডেট কতটুকু আছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। সংস্কার কমিশনের লোকজন সকালে এক রকম, বিকেলে আরেক কথা বলছেন। কাজের চেয়ে নিজেদের প্রচারণায় তাদের মনোযোগ বেশী। রিপোর্ট দেয়ার আগেই তারা অবিরাম কথা বলে চলেছেন। তারাও যেন একেকজন উপদেষ্টা। কাজের চেয়ে টেলিভিশনে উপস্থিতির ব্যাপারে তাদের আগ্রহ বেশী। সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে এই সরকার আরও নানা রকম সমস্যায় আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে। দেশে একটা হ য র ল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ একটি অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে কখনওই সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে এই সরকার দেশকে আরও গভীর সংকটের দিকে নিয়ে যাবে। তাই দ্রুত এখন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করাটা এই সরকারের সবচেয়ে বুদ্ধি দীপ্ত কাজ হবে। যদি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এই সরকার নির্বাচনের ব্যবস্থা করে এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তাহলেই হবে তাদের জন্য সবচেয়ে সন্মানের কাজ। এর ফলে দেশও পরিত্রাণ পাবে। নির্বাচন বিলম্বিত হলে এই সরকারের বিরুদ্ধেই জনগণ মাঠে নামবে, আন্দোলন করবে। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। মানুষ আর পারছে না। কর্মসংস্থান নেই, কোথাও কোনও আশার আলো নেই। বাংলাদেশ যেন এক অন্ধকার টানেলে পথ হারিয়ে হাঁতড়ে বেড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতির অবসান হওয়া দরকার। আর এই কারণেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হোক—এটা সকলের প্রত্যাশা করে। বাংলাদেশে এখন যে বিদ্যমান সংকট এবং সমস্যাগুলো আছে এবং নিত্য নতুন দাবিদাওয়া তৈরি হচ্ছে তার সমাধান করতে পারে একমাত্র জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। যারা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং তারা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে একটি নির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। তারা যখন দায়িত্ব গ্রহণ করবে তখন বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করে নির্বাচিত সরকার নিশ্চয়ই সমাধানের পথ বের করবে। তাদের পেছনে থাকবে জনসমর্থন এবং জনগণের ম্যান্ডেট। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। ৫৩ বছরে বাংলাদেশ নানা চড়াই উতরাই পার করেছে। এসময় নানা রাষ্ট্র সংস্কার হয়েছে। সংস্কার কোন এন্টিবায়োটিক না। নিদিষ্ট ডোজ দিলে সব সমস্যা মিটে যাবে। জনগণ প্রজাতন্ত্রের মালিক। তারা ঠিক করবে কোন সংস্কার তারা গ্রহণ করবেন, কোনটি করবেন না। স্যুট টাই পরা জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিরা কোন অধিকারে তাদের অভিপ্রায় জনগণের উপর চাপাবেন? সংস্কারের নামে কালক্ষেপন এই সরকারকে ব্যর্থ করবে। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। কাজেই সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই সঠিক পথে ফিরে আসতে হবে। বাংলাদেশ যে এখন পথ হারিয়েছে সেই পথের ঠিকানা একটাই। তা হলো নির্বাচন। জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
Comments
Ali
3 weeks agoসহমত
Ali
3 weeks agoআমার বলার কিছুই ছিল না
MU Ahmed
3 weeks agoOf Course,De-Railed! Analytical & Attractive Writing...
Leave a Comment