Post Thumbnail

অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস: কি পেল বাংলাদেশ?


ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। শুরু হয়েছিল বৈষম্যমুক্ত আন্দোলন সরকারি চাকরীতে কোটা সংস্কারের দাবী। এরপর ছাত্র-জনতা বিপ্লব। অভ্যুত্থানের পর নতুন আশায় বুক বেঁধেছিল বাংলাদেশ। চারদিকে ধ্বনিত হয়েছিল বৈষম্যমুক্ত এক নতুন বাংলাদেশের। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর একই ঘোষণা দেয়। ৮ আগস্ট প্যারিস থেকে ঢাকার বিমান বন্দরে নেমেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, গোটা বাংলাদেশ হয়ে উঠবে এক পরিবার। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর পেরিয়ে গেছে প্রায় ছয় মাস। স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে জনজীবন। কিন্তু আমরা কি গোটা বাংলাদেশ এক পরিবার হয়ে উঠতে পেরেছি? যে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের অঙ্গীকার আমরা করেছিলাম সেই বাংলাদেশই বা এখন কেমন? গত ছয় মাসে আমাদের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির সমীকরণই বা কি?

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সবাই প্রত্যাশা করেছিল এই সরকার অনেক বেশি প্রোএকটিভ হবে। কিন্তু সরকার সেটা হতে পারিনি। বরং ব্যর্থতার পাল্লাই বেশী ভারি। গোটা বাংলাদেশ এক হয়ে উঠার পরিবর্তে রীতিমতো এখন বিভক্ত হয়ে গেছে। গণহত্যার দায়ে পতিত সরকারের বিরুদ্ধে বিচার কার্য শুরু হয়েছে। সেখানেও আছে বির্তক। গণহারে মামলা দায়ের করা হয়েছে। জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হলেও পরস্পরের প্রতি সন্দেহ, অবিশ্বাস আরও বেড়েছে। প্রত্যাশা-প্রাপ্তির হিসেব মেলেনি অনেক ক্ষেত্রেই। যেমন-

১. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মুখ থুবড়ে পরে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। পুলিশ বাহিনী ব্যতিত চলছিল দেশ। পরে পুলিশ বাহিনী কাজে ফিরলেও আজ ছয় মাস অতিক্রম হতে যাচ্ছে কিন্তু দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি এখন পর্যন্ত। দায়িত্ব গ্রহণের দিন ৮ আগস্ট বিমান বন্দরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, তার সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার বিষয় হবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটা হয়নি। দেশে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বেড়েছে। বেড়েছে সামাজিক অস্থিরতা। ডাকাত আতঙ্কে পাড়া-মহল্লায় মানুষ নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে দিনের পর দিন।

২. দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি: বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের অবস্থা ছিলো নাভিশ্বাস। এর কারণ হিসেবে মনে করা হতো দলীয় সরকারের লোকজনের চাঁদাবাজি, বাজারের সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। অভ্যুত্থানের পর সবার প্রত্যাশা ছিলো এবার এসমস্ত চাঁদাবাজ, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ভেঙে গেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমবে-এমনটাই প্রত্যাশা ছিলো সবার। কিন্তু এর কোনটাই হয়নি। দ্রব্যমূল্য আরও বেড়েছে। বাজারে এখন সয়াবিন তেলের অপ্রতুলতা। বন্ধ হয়নি চাঁদাবাজও। অপ্রতিরোধ্য বাজারের সিন্ডিকেট। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ নিজেও এই শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন।

৩. নতুন করে বৈষম্য সৃষ্টির অভিযোগ: বৈষম্যমুক্ত আন্দোলন থেকেই সৃষ্টি হয় এই অভ্যুত্থান। অভ্যুত্থানের পরপরও ধ্বনিত হয় একটি নতুন বাংলাদেশের, একটি বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের। কিন্তু বাস্তবতা হিতে বিপরীত ঘটেছে। সমাজকে বিভক্ত করা হয়েছে নানা ভাবে। রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করার ইস্যু থেকে শুরু করে প্রশাসনে বৈষম্য, সরকারি চাকরীতে বৈষম্য, জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য সমাজের বিভক্তিকে স্পষ্ট করেছে। ৪৩তম বিসিএসে ভ্যারিফিকেশন নামে বাদ দেওয়া হয়েছে ২৬৭ জনকে। পদোন্নতির জন্য পরীক্ষা পদ্ধতির কথা জানিয়েছে জনপ্রশাসন সংস্কার। এনিয়ে ইতিমধ্যে প্রশাসনে বিভক্তি দেখা গেছে। থেমে থেমে সচিবালয়ের ভেতর সরকারি কর্মচারীদের বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। যা পুরো প্রশাসনের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। অভিযোগ উঠেছে বলপ্রয়োগ করে বিভিন্ন ব্যবসা সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দখলের। আন্তঃক্যাডারের মধ্যে নতুন করে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে।

৪. শিক্ষাঙ্গনে বিশৃঙ্খলা: বছরের প্রথম দিন বরাবরের মতো এবার ঘটা করে পালিত হয়নি ‘বই উৎসব’। এদিন অল্প সংখ্যক পাঠ্য বই পেয়েছেন শিক্ষার্থীরা। সকল পাঠ্য বই পেতে শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করতে হতে পারে এক থেকে দু’মাস পর্যন্ত। এর আগে সারাদেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে। প্রতিষ্ঠান প্রধানদের জোর করে, অন্যায় ভাবে অবসরে পাঠানো হয়। নিয়ম বহির্ভূত ভাবে ঢালাও ভাবে এটা করা হয়। কোন কোন জায়গায় শিক্ষকদের শারীরিক ভাবে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও চলছে দখলদারের উৎসব। 

৫. নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা: অভ্যুত্থানের পরপর দেশের রাজনৈতিক দলগুলো আশা করেছিল এই সরকার (অন্তর্বর্তী সরকার) আবশিক কিছু সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের একটি পরিবেশ তৈরি করবে। দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে এখন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন যে, ২০২৫ সালের শেষ দিকে অথবা ২০২৬ সালের শুরুর দিকে নির্বাচন হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত নির্বাচনের কোন রোডম্যাপ ঘোষণা করেনি সরকার। এদিকে আবার রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় ‘কিংস পার্টি’ তৈরির গুঞ্জন উঠেছে। কোন কোন মহল থেকে দেশে আবার এক এগারো কায়েম করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। 

৬. অর্থনৈতিক সংকট: ডিসেম্বর পর্যন্ত রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এলেও ডলারের দাম কমছে না। খোলা বাজারে এখনো ডলারের দামে আগুন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণ বাজারের ওপর ছেড়ে দিলেও কমছে না। বরং সপ্তাহের ব্যবধানে আরও বেড়েছে। খোলা বাজারে কোথাও কোথাও ১২৯ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছে মার্কিন ডলারের। এদিকে দেশে নতুন কোন বিনিয়োগ নেই। দেশীয় উদ্যোক্তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে হামলা, অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ফলে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনার পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

 


Comments

Leave a Comment


Related Articles