মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে কোনো শক্তি ধ্বংস করতে পারবে না
তানভীর মোকাম্মেল বাংলাদেশের সুপরিচিত একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা ও লেখক। তানভীর মোকাম্মেল দশবার জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন এবং বাংলাদেশ সরকারের "একুশে পদক"-য়ে ভূষিত হন। বিভিন্ন সময়ে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে ও সিনে সেন্ট্রাল ও আইজেস্টাইন সিনে ক্লাবের আয়োজনে এপার বাংলায় তানভীর মোকাম্মেলের চলচ্চিত্রসমূহ "নদীর নাম মধুমতী', "চিত্রা নদীর পারে', "লালসালু", "লালন", "রাবেয়া', "জীবনঢুলী', "রূপসা নদীর বাঁকে" এবং "১৯৭১", "সীমান্তরেখা", "অয়ি যমুনা', "অচিন পাখী', "কর্ণফুলীর কান্না', "স্বপ্নভূমি', "তাজউদ্দীন আহমদ: নিঃসঙ্গ সারথি', "বস্ত্রবালিকারা' ছবিগুলো দেখানো হয়েছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর তানভীর মোকাম্মেল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের গবেষিকা দেবস্মিতা মহাজনকে বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ে একটি সাক্ষাৎকার দেন। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় 'নাগরিক'-য়ের এই সংখ্যায় সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হল।
দেবস্মিতা মহাজন: বর্তমান সময়কালে সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে যে বিক্ষোভ-আন্দোলন সংগঠিত হল তার খবর সংবাদপত্র এবং বৈদ্যুতিন ও গণমাধ্যমের সূত্রে আমরা কিছু কিছু জানতে পারছি। আপনার দেশে যে সব ঘটনা ঘটছে সেগুলো আপনি কীভাবে দেখছেন?
তানভীর মোকাম্মেল: আপাতদৃষ্টিতে এটি ছিল ছাত্র-জনতার একটি গণ-আন্দোলন। কিন্তু নেপথ্যে তা ছিল শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানোর জন্য আমেরিকার সিআইএ ও পাকিস্তানের আইএসআই দ্বারা পরিকল্পিত, মার্কিন প্রশাসনের অর্থায়ন ও সহযোগিতায় জামাত-ই-ইসলামী, হিজবুত তাহরী এবং অন্যান্য ইসলামিক শক্তিগুলির এক ইসলামী অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটা অংশেরও যোগসাজশ ছিল। সংঘর্ষে এতোজন ছাত্র ও তরুণের মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু এসব করুণ মৃত্যু থেকে সৃষ্ট সহানুভূতিকে পুঁজি করে অত্যন্ত সুকৌশলে এক পরিকল্পনা কার্যকর করা হয়েছে। এই সমগ্র বিষয়টিকে কেউ 'রঙিন অভ্যুত্থান' বলে অভিহিত করতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে কাছাকাছি এ রকম ঘটনা ঘটিয়ে নাম দেওয়া হয়েছিল 'আরব বসন্ত'। কিংবা ইউক্রেনের কথাই ধরুন। যেসব সাময়িক গণ-অভ্যুত্থান আসলে মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থকেই সাহায্য করেছে। পাকিস্তানে নির্বাচিত ইমরান খান সরকারকে ফেলে দেওয়ার দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যাঁর উপর ছিল, সেই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ডোনাল্ড লুর উপরেই দায়িত্ব পড়ে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানোর এবং সেই কাজে তিনি ও তাঁর টীম সফল হয়েছেন। আসলে আমেরিকা চাইছিল বাংলাদেশ মার্কিন নেতৃত্বাধীন এবং ভারত ও চীনবিরোধী ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে যোগ দিক। কিন্তু শেখ হাসিনা সেটা চাননি। তাছাড়া শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশকে "ব্রিকস"-য়ে যোগ দেওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন। চাইছিলেন বি-ডলারিকরণ বা ডলারকে বাদ দিয়ে চীন, ভারত ও রাশিয়ার সাথে তাদের মুদ্রায় ব্যবসা-বাণিজ্য করতে। এখন ডলার হচ্ছে মার্কিন অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম প্রধান শক্তি। ফলে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার আমেরিকার প্রিয় ছিল না। এটা ঠিক যে শেখ হাসিনার সরকারে ও তাঁর আশেপাশে অনেক দুর্নীতিবাজ লোকজন ছিল। তবে দুর্নীতির বিষয়টা অনেকটা অজুহাত হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ আমেরিকা যাঁকে বসিয়েছে সেই আমেরিকা থেকে উড়ে আসা প্রফেসর ইউনুসের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির সুস্পষ্ট অভিযোগ হয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কল্যাণ ট্রাস্টের পঁচিশ কোটি টাকা তছরূপ করার অভিযোগে তাঁর কারাদণ্ডেরও আদেশও হয়েছিল। শেখ হাসিনার সরকারের পতন না হলে দুর্নীতির দায়ে তাঁকে জেল খাটতে হোত। এছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে ছয়শ পঁয়ষট্টি কোটি টাকার কর ফাঁকির একটা মামলা রয়েছে। তাই দুর্নীতি বা অপশাসন নয়, শেখ হাসিনার সরকারকে হটিয়ে ইউনুস সরকারকে বসানোর কারণটা মূলত ভূ-রাজনৈতিক।
দেবস্মিতা মহাজন: আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি আসলে বাংলা ভাগের এক ধরণের পরিণতি?
তানভীর মোকাম্মেল: প্রত্যক্ষভাবে অবশ্যই নয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির সব বড় ঘটনা, বা বলা যায়, এই উপ-মহাদেশের বড় বড় রাজনৈতিক ঘটনাবলী কোনও না কোনও ভাবে ১৯৪৭-য়ের দেশভাগের ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, যদিও কখনও কখনও তা তেমন সুস্পষ্ট না। বাংলাদেশের বিক্ষোভকারীরা যেসব ভারতবিরোধী (পড়ুন হিন্দুবিরোধী) স্লোগান দিয়েছিল তা প্রমাণ করে যে সাম্প্রদায়িকতা এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও দেশটার জনগণের মানসিকতায় এক বড় চালিকাশক্তি। শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও তাঁর দেশত্যাগ করার পরে অনেক হিন্দু বাড়ি, সম্পত্তি ও মন্দিরে হামলা হয় বা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এবং সাম্প্রদায়িকতার যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা অতীতে গিয়েছি, এসব ঘটনা কোনো না কোনোভাবে তো সেই অভিজ্ঞতারই এক ধরণের অনুরণন। সুতরাং ১৯৪৭ সালের বাংলাভাগের সময় যে বিষয়গুলি প্রাসঙ্গিক ছিল এখনকার ঘটনাবলীতেও সেসবের কিছু প্রাসঙ্গিকতা তো রয়েই গেছে।
দেবস্মিতা মহাজন: প্রশাসক হিসাবে শেখ হাসিনা কি কি ভুল করেছেন যা সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলল?
তানভীর মোকাম্মেল: আমি মনে করি কিছু কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে অর্থনীতির ক্ষেত্রে, শেখ হাসিনার সরকারের বেশ সাফল্য ছিল। তবে ওই সরকারটার বেশ কিছু দুর্বলতাও ছিল। শেখ হাসিনা নিজের দলের ও দেশের প্রায় সর্বস্তরে ছড়ানো দুর্নীতির বিরুদ্ধে তেমন কোনো শক্ত পদক্ষেপ নেননি। তাঁর পতনের আরেকটি কারণ হোল তাঁর বাড়তি কথা বলার অভ্যাস। এই বাচালতা কখনও কখনও এমন পর্যায়ে চলে যেত যা মোটেই রাষ্ট্রনায়কসুলভ নয়, বরং তা মানুষের মনে বিরক্তিরই উদ্রেক করত। তাঁর বাকসর্বস্বতা, অত্যধিক আত্মবিশ্বাস এবং একগুঁয়েমি, যা সৃষ্ট হয়েছিল তাঁকে ঘিরে রাখা তোষামোদকারীদের কারণে, তাঁকে দেশের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা অন্ধকারেই রেখেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চক্রান্তটিও ছিল বিশাল, বহুধা বিস্তৃত এবং অনেক গভীরে প্রোথিত যা মোকাবেলা করার কৌশল তাঁর জানা ছিল না। আর এর জন্য তাঁকে বা তাঁর দল আওয়ামী লীগকেই শুধু নয়, গোটা বাংলাদেশকেই চরম মূল্য দিতে হলো। বলা চলে, বাংলাদেশের মানুষ গামলার দূষিত জলের সাথে শিশুটাকেও যেন ছুঁড়ে ফেলল! আমার মনে হয় এজন্য ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের মানুষকে আরো অনেক মূল্য দিতে হবে। বাংলাদেশ এখন একটা গোঁড়া ইসলামী শাসনের অন্ধকারময় যুগের দিকে পা বাড়িয়েছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে সেটা হতো না। আমার বিবেচনায়, শেকসপিয়র 'কিং লীয়র'-য়ে যেমনটা বলেছিলেন, শেখ হাসিনাও বাংলাদেশের ইতিহাসে তেমনই একজন নেত্রী, যিনি "more sinned against the sinning"
দেবস্মিতা মহাজন: আপনি ১৯৪৭ এর দেশভাগের কথা জেনেছেন, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও এখনকার ঘটনাবলীও প্রত্যক্ষ করছেন। একজন ব্যক্তি হিসেবে কি ভাবে এই পরিস্থিতির মূল্যায়ন করবেন?
তানভীর মোকাম্মেল: ১৯৪৭-য়ের দেশভাগ এবং ১৯৭১-য়ের মুক্তিযুদ্ধ দুটোই যুগান্তকারী দুই ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৪৭-য়ের ঘটনায় এই উপমহাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখা পরিবর্তিত হয়ে গেল, জনবিন্যাসও পাল্টে গেল। আর ১৯৭১-য়ের মুক্তিযুদ্ধও ছিল আরেক মহাকাব্যিক ঘটনা। মুক্তির সেই সংগ্রামে ত্রিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়, দুই লক্ষ নারী ধর্ষিতা হয়, এক কোটি মানুষ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। উভয় ঘটনাতেই হিন্দু জনগণ ব্যাপকভাবে গণহত্যার শিকার হয়। এই দুটি ঘটনাই আমাদের এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তিটাকেই বলতে পারেন ওলট পালট করে দিয়েছিল এবং তা প্রায় এক চিরস্থায়ী প্রভাব রেখে চলেছে। সে তুলনায় বাংলাদেশের ২০২৪-য়ের ছাত্র গণ- আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সৃষ্ট দাঙ্গা ও অরাজকতার ঘটনা ব্যাপকতায় অনেক কম এবং এর প্রভাবও অনেক কম রইবে।
দেবস্মিতা মহাজন: আজকের ছেলেমেয়েরা যারা বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার পক্ষে অতি তরুণ তাদের কাছে বাংলাদেশকে কিভাবে বর্ণনা করবেন?
তানভীর মোকাম্মেল: বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে একটি রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। শুরু থেকেই দেশটি নানা রকম অস্থিতিশীলতা ও উত্থান পতনের কারণে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। তা সত্বেও দেশটা সামনেই এগিয়ে যাচ্ছিল। এক সময়ের পশ্চাৎপদ পূর্ববঙ্গের সাম্প্রদায়িক কালের অর্থনৈতিক উন্নতিটা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাগতভাবে এক। আবার জনগণের নয় শতাংশ বাদে সব মানুষই একই ধর্মের অনুসারী। আমার অনুমান, বর্তমান সময়ের এই অস্থিরতা সত্বেও, বাংলাদেশের জনগণ শান্তি চায়। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে যারা এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে, বিশেষত: ইসলামী শক্তিগুলি, তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও আধিপত্যবাদী ইসলামী ধর্মীয় শাসন কায়েম করার চেষ্টা চালাতে থাকবে। এর ফলে দেশটার মানুষের মধ্যে গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতা ব্যাপকহারে বাড়বে। এই বিষয়ে এখনই আমরা অনেক অশুভ ইঙ্গিত পাচ্ছি। তাই ১৯৭১-য়ে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম আগামীতে তা গভীর হুমকির মধ্যে পড়বে বলেই আমার ধারণা। বাংলাদেশের সমাজ বহুত্ববাদের বদলে পরিবর্তিত হয়ে ক্রমশ: একরৈখিক ইসলামীকরণের দিকে চলতে থাকবে এবং আগামী দিনে এই অভিমুখ আরও তীক্ষ্ম হবে। এর ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ও নৃতাত্ত্বিকভাবে ভিন্ন পাহাড়ী জনগোষ্ঠী বিপদে পড়বেন। তবুও আমি বিশ্বাস করি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্মৃতি ও মূল্যবোধগুলো বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে এতো গভীরভাবে প্রোথিত যে তাকে সর্বাংশে উপড়ে ফেলা সম্ভব হবে না।
ভাষান্ত: মনিরুল হক
Comments
Leave a Comment