Post Thumbnail

আওয়ামী লীগ কি আয়নায় মুখ দেখবে?


৭৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল যাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো, যে দলটি ৭৫’র পরে ২০ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলো। টানা ১৬ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড গড়েছিলো যে দলটি, ৫ আগস্ট সেই দলটির ‘মহাপলায়ন’ ঘটে। আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। দলের অধিকাংশ শীর্ষ নেতারা আত্ম-গোপনে কিংবা পলাতক। কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাদের বেশিরভাগ বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের কোন শীর্ষ নেতাকে এখন পর্যন্ত সাহসের সঙ্গে সামনে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। কেউ জেলে, কেউ বিদেশে। বিদেশে বসে কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কয়েকজন যেন গভীর সমুদ্রে ডুব দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের এই মহা পলায়ন কেন? আওয়ামী লীগ কেনই এই মহা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ল তা নিয়ে রাজনীতিতে বড় ধরনের আলোচনা হতে পারে। টানা ক্ষমতায় থাকা একটি দল এরকম বিপর্যস্ত, লন্ডভন্ড, ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো কিভাবে সেটি নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় গবেষনার বিষয়। 

আওয়ামী লীগের নেতারা বলতেই পারেন, ৫ আগস্টের দিন থেকে তাদের উপর যেভাবে নির্যাতন, নিপীড়ন এবং হামলা হয়েছে এছাড়া তাদের কোন বিকল্প পথ ছিলো না। এটি যদি আমরা মেনেও নেই তারপরও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের এভাবে পলায়ন রাজনীতিতে হাস্য কৌতুকেরও জন্ম দিয়েছে। ৭৫ সালেও আওয়ামী লীগ এমন কাপুরুষোচিত আচরণ করেনি। শুধু কি জনরোষের কারণেই তারা পালিয়েছেন নাকি তাদের নিজেদের ভুল এবং ব্যর্থতা ঢাকার জন্য তারা পালিয়েছেন? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এরকম পরিস্থিতি কেন হলো? ৫ আগস্টের ঘটনা কেন ঘটলো, এখানে তাদের দায়-দায়িত্ব কতটুকু, কি কারণে এই বিক্ষোভ এবং অভ্যুত্থান সৃষ্টি হলো তা কি আওয়ামী লীগ মূল্যায়ন করবে? আয়নায় কি আওয়ামী লীগ নিজেদের চেহারাটা দেখবে? কেন তাদের এই পরিণতি বরণ করতে হলো?

আওয়ামী লীগের পলাতক এবং আত্মগোপনে থাকা নেতারা এখন গর্ত থেকে বেরিয়ে নানারকম বিবৃতি-বক্তব্য দিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগের অনেক কর্মী সজাগ সচেতন-সক্রিয়। কিন্তু একটি বিষয় একেবারেই মিসিং। আওয়ামী লীগের কোন পক্ষ থেকেই আত্ম-শুদ্ধি বা সমালোচনা নেই। তাদের ভুল-ত্রুটি গুলো নিয়ে কোন রকম চর্চা নেই। এটি আতংকের কারণ। ৫ আগস্টের পরিণতি কেন তৈরি হলো তার পেছনের কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগ এখনই বলতে শুরু করেছে, এটি ছিলো স্রেফ একটি ষড়যন্ত্র। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটি ‘ম্যাট্রিকুলাস প্ল্যান’ বাস্তবায়িত হয়েছে এবং ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগকে উৎখাত করা হয়েছে। শুধু ষড়যন্ত্র করে গণঅভ্যুত্থান হয় এমন চিন্তা যদি আওয়ামী লীগ করে থাকে তাহলে আওয়ামী লীগ মহা ভুল করছে। এটি পরিকল্পিত হোক, ষড়যন্ত্র হোক জনগণের একটি বড় অংশের সমর্থন ছিলো। তারা আওয়ামী লীগের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়েছিলো, হতাশ হয়েছিলো এবং অনাস্থা প্রকাশ করেছিলো। এটিই বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতে হবে আওয়ামী লীগকে। যতক্ষন আওয়ামী লীগ এটি স্বীকার করতে না পারবে ততক্ষন তারা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে না বলেই আমি মনে করি। 

আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামল এবং এই সময়ের সাংগঠনিক অবস্থা যদি নির্মোহভাবে বিশ্লেষন করা যায়, তাহলেই বোঝা যাবে কিভাবে আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো, কিভাবে জনগণের কণ্ঠস্বর আওয়ামী লীগের কাছে পৌঁছানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো এবং কি কারণে এই গণঅভ্যুত্থান পল্লবিত হলো। 

দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ প্রথম ৫ বছর অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ দখল করে নেয় সুবিধাবাদী গোষ্ঠী। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে একথা কেউ অস্বীকার করে না। বাংলাদেশের মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে, ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও একটি কর্মচাঞ্চল্য ছিলো চোখে পরার মতো। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির দুর্নীতি সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো। আর এই সব দুর্নীতির কথা সকলেই জানতো। সালমান এফ রহমান, এস. আলম কিংবা বিভিন্ন ব্যাংক ডাকাত, লুটেরারা আওয়ামী লীগের ছত্র-ছায়ায় দানবে পরিণত হয়েছিলো। এসমস্ত দানবরা ছিলো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এসমস্ত দানবরাই যে আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছে প্রশ্ন বিদ্ধ করেছে তা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। আওয়ামী লীগ কি এটি জানে? 

আওয়ামী লীগ যতটা না সংগঠনের উপর নির্ভরশীল ছিলো তার চেয়ে বেশি নির্ভরশীল ছিলো আমলাতন্ত্র, পুলিশ সহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের উপর উপর। তাও পুরো প্রতিষ্ঠান নয়। বরং ঐসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন ব্যক্তি যেন আওয়ামী লীগের সর্বেসর্বা এবং আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক হয়ে উঠেছিলো। আমলাদের কথাই যদি আমরা ধরি তাহলে হাতে গোনা কয়েকজন আমলা ছিলেন আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক। তাদের কথায় বাদবাকি সব আমলাদের পদোন্নতি হতো। তারা শুধু আমলাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রকই তারা ছিলেন না। তারা রাষ্ট্রেরও নিয়ন্ত্রকে পরিণত হয়েছিলেন। আর এটির সুযোগে তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে লুণ্ঠনের ঠিকাদারি পেয়েছিলেন। এইসমস্ত আমলাদেরকে সকলেই চেনে। আমলা-পুলিশ বাহিনীতে এরকম মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি আওয়ামী লীগের সর্বনাশের জন্য দায়ী। এটি আওয়ামী লীগকে নির্মোহভাবে স্বীকার করতেই হবে। 

আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও দেখা গিয়েছিলো হাইব্রিড এবং অতিথি পাখিদের দৌরাত্ম। যারা আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের ত্যাগী, পরীক্ষিত তারা আস্তে আস্তে দূরে সরে গিয়েছিলো। একসময় তারা আওয়ামী লীগের ক্ষমতা কেন্দ্র থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। বরং আওয়ামী লীগে এসেছিলো একধরনের অতিথি পাখি। ডানা কাটা পরীর মতো এসমস্ত স্তাবকের দল শেখ হাসিনাকে ঘিরে রেখেছিলো। শুধুমাত্র চাটুকারিতা এবং মিষ্টি কথার ফুলঝড়িতে তারা বাস্তবতাকে আড়াল করেছিলো। সংগঠনে পদ কেনা-বেচা ছিলো ওপেন সিক্রেট। সংগঠনে ওবায়দুল কাদেরের মতো একজন অযোগ্য, অথর্ব, দায়িত্ব জ্ঞানহীন ব্যক্তি তিন তিন বার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যিনি শুধু সংগঠনকেই ধ্বংস করেননি আওয়ামী লীগের ইমেইজকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামীগের সংগঠনের যে কি করুন দশা হয়েছে ৫ আগস্টের পর তা প্রমাণিত হয়েছে। 

আওয়ামী লীগের অদ্ভুত একটি ব্যাপার রয়েছে। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের যেসমস্ত নেতা-কর্মীরা আছেন তারা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন। তাদেরকে দূরে ঠেলে দেয়া হয়। তারা যেন দলের জন্য অপ্রয়োজনীয় হয়। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার ফলে তারা দলে ক্রমশঃ অপাংক্তেয়, অনাহুত হয়ে পড়েছিলেন। এসমস্ত ব্যক্তিরাই আসলে আওয়ামী লীগের প্রাণ। এখন যে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে টুক-টাক প্রতিবাদ করছে, সংগঠনকে নতুন ভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে তা এসমস্ত কর্মীরাই। কিন্তু এসমস্ত কর্মীদেরকে রীতিমতো বাঘের মুখে ছেড়ে দিয়ে নেতারা পালিয়েছেন। এসমস্ত কর্মীদের কোন পদ নেই এবং তাদের কোন ঠিকানাও নেই। অথচ মার খাচ্ছেন তারাই। এখন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের দুর্নীতি এবং অপকর্মের দায় মেটাতে হচ্ছে এসমস্ত নিরীহ কর্মীদেরকে। 

১৫ বছরে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী কতজন? ৫ হাজার! ১০ হাজার! সর্বোচ্চ ২০ হাজার। কিন্তু আওয়ামী লীগে কর্মীর সংখ্যা কত? এক কোটি কিংবা তারও বেশি। অধিকাংশ আওয়ামী লীগের কর্মীরাই এই ১৫ বছরে হালুয়া-রুটির ভাগ পাননি। এদের অধিকাংশই শুধুমাত্র আদর্শের জন্য দল করেছে। অধিকাংশই আওয়ামী লীগকে ভালোবেসেছে। আওয়ামী লীগের জন্য তারা জীবন উৎসর্গ করতে পারে। এসমস্ত কর্মীরা দুঃসময়ে ঠিকই দাড়ায়। কিন্তু সুসময়ে তারা কোন জায়গা পায় না। সুসময়ে আওয়ামী লীগে ভীড় করে সব অনুপ্রবেশকারী সুবিধাভোগী, দুর্নীতিবাজ, চাটুকার, দুর্বৃত্তরা। এরাই আওয়ামী লীগের দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে যায়। এরাই আওয়ামী লীগকে নিয়ন্ত্রণ করে। এদের কারণে আওয়ামী লীগ অস্তিত্বের সংকটে পরে। 

আওয়ামী লীগের ‘মহা পলায়ন’ আওয়ামী লীগের জন্য এ সত্যটিকে নতুন করে সামনে এনেছে। এখন আওয়ামী লীগ এই সরকারের বিরুদ্ধে নতুন করে আন্দোলনের কথা ভাবছে। ইতোমধ্যেই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করারও কথা-বার্তা রাজনীতির মাঠে চর্চা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কি হবে তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু আওয়ামী লীগকে সবার আগে আত্ম মূল্যায়ন করতে হবে। যে সমস্ত দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজ, সুবিধাভোগী, চাটুকারদের জন্য আওয়ামী লীগের এই হাল তাদেরকে আগে চিহ্নিত করতে হবে। দল থেকে তাদেরকে বিদায় করতে হবে। আওয়ামী লীগে অনেক নিবেদিত প্রাণ, আদর্শবাদী, নির্লোভ, সৎ, ত্যাগী কর্মী রয়েছে। তাদেরকে সামনে আনতে হবে সবার আগে। আয়নায় আওয়ামী লীগকে মুখ দেখতে হবে। আওয়ামী লীগ কি তা পারবে?  


Comments

Leave a Comment


Related Articles