‘ডেথ জোন’ মোহাম্মদপুর
শান্ত সিংহ: শারমিন আক্তার (ছদ্মনাম) ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। গ্রামের বাড়ি দোহারে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের সুবিধার জন্য মোহাম্মদপুর এলাকায় খালার বাসায় থাকেন। গত ২১ অক্টোবর ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বাসা থেকে বের হন। বাসার গেটের বাইরে বের হতেই সেদিন তিনি ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন। কয়েকজন হাতে ধারালো অস্ত্র নিয়ে পেছন দিক এসে তাকে ঘিরে ফেলেন। একপর্যায়ে ব্যাগ ধরে টানাহেঁচড়া শুরু করে। ব্যাগ দিতে না চাইলে তারা বড় বড় ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে কোপ দিতে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে জীবন বাঁচাতে তিনি বাসার দিকে দৌড় দেন। সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে যান শারমিন। তবে ব্যাগে মোবাইল, টাকা, আইডিকার্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাগজপত্র ছিল সব হারিয়েছেন তিনি। তাঁর বড় বোনের দাবি ওই ঘটনায় তাঁর বোন প্রচন্ড ভয় পেয়েছেন এবং সেদিনের পর থেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।
মো. আব্দুল মানিক একজন চিকিৎসকের ব্যক্তিগত গাড়ি চালক হিসেবে কাজ করছেন। প্রতিদিনের মতো চেম্বার শেষ করে চিকিৎসককে বাসায় রেখে রিক্সায় করে তিনি ঘরে ফিরছিলেন। তাজমহল রোড়ে হঠাৎ কয়েকজন কিশোর এসে অস্ত্র দিয়ে তাকে জিম্মি করে এবং মোবাইল এবং টাকা পয়সা যা পান সব নিয়ে যায়। তাঁরা সবাই সশস্ত্র থাকার কারণে প্রতিবাদ পর্যন্ত করার সাহস পাননি মি. মানিক। সেদিনের ওই ঘটনা প্রতি মূহূতে তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে বলে দাবি তাঁর।
শুধু শারমিন আক্তার বা মি. মানিক-ই এমন ঘটনার শিকার নয়। মোহাম্মদ এলাকায় কান পাতলেই এমন শত শত ঘটনার কথা শোনা যায়। সম্প্রতি ঢাকা উদ্যান, একতা, নবোদয়, নবীনগর ও শ্যামলী হাউজিং এবং তুরাগ নদসংলগ্ন ওয়াকওয়েতে ডাকাতির আতঙ্ক জেঁকে বসে এলাকাবাসীকে। প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে এমন পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে। দিনের আলো নিভলেই জেঁকে বসছে ডাকাত আতঙ্ক।
সম্প্রতি মোহাম্মদপুরে ঘটে যাওয়া একাধিক ঘটনার খন্ডিত চিত্র।
স্থানীয়রা জানান, একদল উচ্ছৃঙ্খল যুবক চাপাতি হাতে দৌড়ায় আর কোপায়। সামনে যাকে পায়, কুপিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। রেহাই পান না দোকানিরাও। দিন-দুপুরেও দোকানের ভেতর ঢুকে নির্দ্বিধায় ছিনতাই করে যাচ্ছে তাঁরা।
গত ২০ অক্টোবর সকাল পৌনে ১০টার দিকে মোহাম্মদপুর হাউজিং লিমিটেড এলাকায় দিনে-দুপুরে ফিল্মি স্টাইলে ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে নেসলে কোম্পানির একটি গাড়ি। গাড়ি আটকিয়ে অস্ত্রের মুখে সেদিন ১১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ছিনতাই করে নিয়ে যায় ৬ দুর্বৃত্ত।
এলাকাবাসী জানান, আগস্টের মাঝামাঝি সময় থেকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। নিজেকে বাঁচাতে জীবনবাজি রেখে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের। প্রয়োজনীয় কাছেও বাসা থেকে বের হতে হচ্ছে জীবন বাজি রেখে। এছাড়া কিছুদিন পরপর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে মাদক কারবারিদের গোলাগুলিতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। পরিস্থিত এমন যে মোহাম্মদপুর এলাকা যেন এখন এক ‘ডেথ জোনে’ পরিণত হয়েছে।
এদিকে, গতকাল রোববার রাতে ডিবি প্রধানকে উদ্ধৃতি করে মসজিদের মাইকে ঘোষণা করতে শোনা গেছে যে, রাত ১১টার পর কেউ যেন বাসার বাইরে বের না হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে এরকম ছিনতাই, ডাকাতি, হামলা, ধর্ষণ সহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ঘটনায় পুরো এলাকাবাসী চরম অনিশ্চিয়তা এবং উদ্বেগের সঙ্গে বাস করছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, গত শনিবার নিরাপত্তা চেয়ে মোহাম্মদ এলাকাবাসী থানা ঘেরাও করেছে। পরের দিন রোববার দুপুরে ঢাকা উদ্যান ও চাঁদ উদ্যােনে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প বসানো হয়েছে।
গতকাল রোববার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান ও নবোদয় হাউজিং এলাকায় যৌথ অভিযানে ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ ও কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধ দমনে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া খুবই জরুরি। কিন্তু তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার সঙ্গে বিভিন্ন মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।
Comments
Leave a Comment