কেন ঘোষিত হলো না বিপ্লবের ঘোষণাপত্র
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষণা করেছিল ৩১ ডিসেম্বর তারা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র দিবে। ফেসবুকে তারা পোষ্ট করেছিল, ‘৩১ ডিসেম্বর! নাও অর নেভার!’ ‘এ বছরই হবে। ৩১ ডিসেম্বর। ইনশাআল্লাহ!’ কিন্তু ৩০ তারিখ মধ্যরাতেই জানা গেল ৩১ ডিসেম্বর তারা কোন ঘোষণাপত্র দিচ্ছে না। অর্থাৎ আজ ঘোষিত হচ্ছে না ‘ঘোষণাপত্র’। প্রশ্ন হলো তাহলে কবে? নাকি আর ঘোষিতই হবে না বিপ্লবের ‘ঘোষণাপত্র’?
গত কয়েকদিন ধরেই ৩১ ডিসেম্বর নিয়ে সয়লাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এর কারণ শনিবার রাতে হঠাৎ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, রিফাত রশিদ, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন এর ফেসবুক পোস্ট। হাসনাত আব্দুল্লাহ লেখেন, ‘কমরেডস, ৩১ ডিসেম্বর! নাও অর নেভার!’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক রিফাত রশিদ তার ফেসবুকে লেখেন, ‘৩১ ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এখন পর্যন্ত তাদের সবচেয়ে বড় বিপ্লবী স্টেপ নিতে যাচ্ছে।’ আসিফ মাহমুদ তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লেখেন, ‘কমরেডস, নাও অর নেভার’। জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন তার ব্যক্তিগত ফেসবুকে লেখেন, ‘এ বছরই হবে। ৩১ ডিসেম্বর। ইনশাআল্লাহ!’ এর পরপরই শুরু হয় নানা জল্পনা-কল্পনা। কি হতে যাচ্ছে ৩১ ডিসেম্বর? পরের দিন রোববার এক জরুরি সংবাদ সন্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জানাল ৩১ ডিসেম্বর জুলাই বিপ্লবের ঘোঘণাপত্র দেওয়া হবে। আর এর মধ্য দিয়ে বাহাত্তরের সংবিধানের কবর রচনা করা হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির এমন অবস্থানের পরপরই প্রশ্ন উঠে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা নিয়ে। কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে উঠেছে বাহাত্তরের এই সংবিধানকে ভিত্তি করে। ফলে একই সঙ্গে বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রশ্নটিও সামনে চলে সামনে। বাহাত্তরকে কবর দেওয়া হলে বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা হয় কিনা সেই প্রশ্নও উঠে। জুলাই বিপ্লবের ঘোঘণাপত্র নিয়ে গোটা জাতির মধ্যে এক বিভ্রান্ত তৈরি হয়। এরকম বাস্তবতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মো. শফিকুল আলম রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সরকারের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই বলে জানান। তিনি বলেন, ‘এটি একটি প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ। আমরা এটিকে প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ হিসেবেই দেখছি। সরকারের সঙ্গে এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। যাঁরা এটিকে সাপোর্ট করছেন, এটা প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভকে সাপোর্ট করছেন।’
ছাত্র আন্দোলনের জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের বিষয়টি সামনে আসার পর রাজনৈতিক অঙ্গনেও ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। দেশের মধ্যে নতুন করে বিভক্তি সৃষ্টির চেষ্টারও অভিযোগ উঠে। অভিযোগ উঠে রাজনৈতিক দলগুলো বা অন্য স্টেকহোল্ডারদের সাথে কোন রকম আলাচনা না করার। ছাত্র আন্দোলনের এই উদ্যোগ (জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র) জাতির মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করবে বলেও কোন কোন দল মন্তব্য করে। আজ দৈনিক যুগান্তরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বাহাত্তরের সংবিধান বাতিলের দাবি এই মুহূর্তে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। তিনি ছাত্রদের এই দাবিকে আবেগপ্রবণ বলে মন্তব্য করেছেন। এর ফলে এটি সুস্পষ্ট যে, ছাত্রদের ঘোষণাপত্রের ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐক্য নেই। এটি বিভক্তিই সৃষ্টি করবে। এরকম বাস্তবতায় পিছু হটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সোমবার দিবাগত রাত পৌনে ২টার দিকে বাংলামোটরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। ঘোষণাপত্রের পরিবর্তে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি ঘোষণা করে ছাত্র আন্দোলন।
এদিকে সোমবার রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে এক জরুরি প্রেস ব্রিফিং করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এ সময় তিনি জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অথচ ঠিক আগের দিন রোববার জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেন তিনি। উল্লেখ্য যে, গত ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্রদের এই সরকারের নিয়োগকর্তা হিসেবে দাবি করেন (বিবিসি বাংলা, ২৫ আগস্ট)। ফলে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের নিয়ে ছাত্র আন্দোলনের পিছু টান এবং সরকারের বারবার অবস্থান পরিবর্তনে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাজনৈতিক ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। এই সরকারের রাজনৈতিক ভিত্তি নেই। অন্যদিকে জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যে জনপ্রিয়তা বা গ্রহণযোগ্যতা ছিলো তাতে এখন ভাটার টান।
উল্লেখ্য যে, এর আগেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের বিপরীত অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা সরকারের পরিকল্পনায় নেই বলে একাধিকবার গণমাধ্যমে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ইসলাম। হাইকোর্টে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ চেয়ে রিট করা হলে আদালত তা খারিজ করে দেন। সে সময় রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এম. আসাদুজ্জামানও বলেছেন, কোন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা এই সরকার (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) সমর্থন করে না। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগসহ ১১ রাজনৈতিক দলকে রাজনীতির বাইরে রাখতে চেয়ে আদালতে রিট করেছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা সারজিস আলম ও আবুল হাসনাত। কিন্তু একদিনের মাথায় তারা সেই রিট প্রত্যাহার করে নেন। একই রকম অবস্থা দেখা গেছে রাষ্ট্রপতির থাকা না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েও। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে সরকারকে আল্টিমেটাম দিলেও সরকার শেষ পর্যন্ত সে পথে হাটেনি।
Comments
Leave a Comment