ছাত্রলীগ-যুবলীগ ধ্বংস করল কে?
আশির দশকে ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় বিভিন্ন দেয়ালে লেখা একটি স্লোগান সাড়া ফেলেছিল। সেই স্লোগানটির দিকে অনেকেই তাকিয়ে হাসতেন। রাজনীতিতে এক কৌতুকের জন্ম দিয়েছিল স্লোগানটি। স্লোগানটি ছিল এই রকম ‘ছাত্রলীগ খাইছি, যুবলীগ খাইছি, এবার আওয়ামী লীগ খামু’- আমি আমির হোসেন আমু। সেই সময়টা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরের। তখন আমির হোসেন আমু আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পাদপ্রদীপে এসেছিলেন। শেখ হাসিনার অন্তত ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত পেয়েছিলেন। আমু হয়ে উঠেছিলেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক। তখন আওয়ামী লীগ নানা উপদলে বিভক্ত। সেই উপদলে বিভক্ত থাকার কারণে আমির হোসেন আমু’র বিরোধীরা এই স্লোগানটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল বিভিন্ন অলিতে গলিতে লিখে। এত বছর পর এই স্লোগানটির কথা মনে পড়ল যখন যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী কর্মসূচিহীন ভাবে পালিত হল।
বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শেখ ফজলুল হক মনি এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংকটে যুবলীগ অন্তত শক্তিশালী সাংগঠনিক অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং অন্যতম প্রধান প্রতিবাদী যুব সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যে সংগঠনটি প্রথম প্রতিবাদ করতে পেয়েছিল সে সংগঠনটি ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। এছাড়াও ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন বিপর্যস্ত অবস্থায় তখন যুবলীগই রাজপথে আওয়ামী লীগকে নতুন জীবন দেয়। ২০০৭ সালে এক এগারোর সময়ের সংকটেও যুবলীগ আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে প্রেরণার উৎস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিল। কিন্তু সেই যুবলীগ এখন বিবর্ণই শুধু নয়, মৃত প্রায়। যুবলীগ সংগঠনটা কে খেয়ে ফেলছে?
শুধু যুবলীগ কেন? ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগের পতনের পর দেখা যাচ্ছে যে, ছাত্রলীগ, যুবলীগ সব সংগঠনগুলোকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাওয়া হয়েছে। এই সংগঠনগুলো গত ১৫ বছরে করা হয়েছে অস্তিত্ববিহীন। যুবলীগের কথাই ধরে নেয়া যাক, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ। তিনি কি সংগঠন করেছেন, তিনি কীভাবে সংগঠন পরিচালিত করেছেন তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু বাজারে চাউর হলো তাঁর স্ত্রী নাহিদ সুলতানা যূথী ছিলেন আওয়ামী যুবলীগের সবকিছুর নীতিনির্ধারক। তাঁর কাছে ‘নগদ নারায়ণ’ না পৌঁছানো পর্যন্ত কোন কমিটির অনুমোদন দেয়া হত না। যূথী’কে নিয়ে যদি কেউ লেখালেখি শুরু করে তাহলে তা লিখে ফুরোবে না। এমন কোন অপকর্ম নেই, এমন কোন দুর্নীতি, কোন দুর্বৃত্তায়ন নেই যেটা যূথীর হাত দিয়ে সম্পন্ন হয়নি। কিন্তু তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য পরশের স্ত্রী। কাজেই তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার টু শব্দটি বলতে পারতেন না। সর্বশেষ সুপ্রিম কোট নির্বাচনকে ঘিরে যূথী যেটা করেছিল তার চেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা আর হতে পারে না। কিন্তু সেই ঘটনারও বিচার হয়নি। যুবলীগ পরশ এবং যূথী তাঁদের পারিবারিক সংগঠন এবং টাকা বানানোর মেশিন হিসাবে পরিণত হয়েছিল। আর এ কারণেই আজকে যুবলীগ সংগঠন বলে কোন কিছু নেই। যুবলীগকে খেয়ে ফেলা হয়েছে। যুবলীগের যে সমস্ত নেতারা দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়ন করেছেন তাঁরা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে। কেউ কেউ কোটি কোটি টাকার সম্পদ বানিয়ে বিদেশে নিরাপদে আরাম আয়াশে জীবন যাপন করছেন। সেখানে বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা রকম বড় বড় বক্তৃতা দিয়ে আন্দোলন- সংগ্রামের কথা বলছেন। দেশে অধিকাংশ কর্মীর অবস্থা অন্তত শোচনীয়। তাঁরা রীতিমতো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বেশির ভাগ কর্মীর চলার অর্থ পর্যন্ত নেই। তাঁদের বিরুদ্ধে নানা রকম মামলা। তাঁরা বাড়ি ঘরে থাকতে পারছেন না। এক অসহায় পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁরা। তাঁদেরকে দেখার কেউ নেই। কিন্তু নেতারা বিদেশে বসে তাঁদেরকে নানা রকম হুকুম দিচ্ছেন আদর্শ কপচানো। গত ১০ নভেম্বর হল তার একটি বড় উদাহরণ। বিদেশে বসে পলাতক আওয়ামী লীগের নেতারা দেশে কর্মীদের আগুনে ঝাঁপ দিতে বলছেন। এই রকম দায়িত্ব জ্ঞানহীনতাই হলো আওয়ামী লীগের পতনের প্রধান কারণ বলে মনে করেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
শুধু যুবলীগ কেন? ছাত্রলীগকেও তো খেয়ে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের পতনের সূচনাই হয়েছিল ছাত্রলীগের অপকর্মের মাধ্যমে। এখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে যে সমস্ত সমন্বয়করা আত্মপরিচয় প্রকাশ করছেন তাঁদের ঠিকুজি খুঁজে দেখা যাচ্ছে যে তাঁরা সবাই ছাত্রলীগের ছায়াতলে নিরাপদে থেকে সরকার পতনে আন্দোলনে জাল বিস্তার করেছিলেন। ছাত্রলীগের নেতাদের একেক জনের বিত্ত বৈভব এবং তাঁদের জীবনযাপনও রূপকথাকে হার মানায়। এই সমস্ত শীর্ষ নেতারাও এখন দেশের বাইরে নিরাপদে পালিয়ে আছেন। সেখান থেকে তাঁরা নানা রকম টকশোতে গাল ভরা বক্তৃতা দিচ্ছেন। অথচ ছাত্রলীগের নিবেদিত প্রাণ কর্মীটি পরীক্ষা দিতে পাচ্ছেন না, পরীক্ষার হলে গিয়ে নিগৃহীত হতে হচ্ছে, পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হচ্ছে। কিন্তু এই সমস্ত দুর্নীতি অনিয়মের ভাগীদার নন। কিন্তু সমস্ত নির্যাতন নিপীড়ন ভোগ করতে হচ্ছে তাঁকে। ছাত্রলীগের যে আদর্শবান কর্মীগুলো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বা শেখ হাসিনার আদর্শকে লালন করে শুধুমাত্র আদর্শিক কারণে ছাত্র রাজনীতি করেছে তাঁরা আজকে সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে। ছাত্রলীগের বহুকর্মী তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে যেতে পারছেন না। তাঁদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তায় ভরা। তাঁদের বিরুদ্ধে নানা রকম মামলা। এই সমস্ত কোমলমতি কিশোর উত্তীর্ণ তরুণদের ভবিষত এক অন্ধকারে অমানিশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাঁদের কথা কে ভাববে? নেতারা নাকি অন্য কেউ? কেউ তাঁদের কথা ভাববে না।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গত পনেরো বছরে একটা নেতৃত্বের দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে। নেতৃত্বে এসেছে এমন কিছু ব্যক্তি, যাঁরা শুধুমাত্র নিজের আখের গুছিয়েছেন। দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। কোন কোন নেতার শতশত বাড়ি ঘরের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এই সমস্ত নেতারা ৫ আগস্টের পরে বিপুল পরিমাণ অর্থে বিনিময়ে ভারতে এবং সেখান থেকে অন্যান্য দেশে চলে গেছেন। আর যে সমস্ত কর্মীরা বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁদেরকে কোন পদ দেওয়া হয়নি, যাঁদেরকে দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছিল, তাঁরা এখন ভয়ংকর এক বাস্তবতার মুখোমুখি। তাঁরা এখন এক বৈরী পরিবেশে জীবন মৃত্যু-সন্ধি ক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁদেরকে এখন লড়াই করার কথা বলা এক ধরনের অপরাধ। আওয়ামী লীগ পনেরো বছরে কমিটি বাণিজ্য করে সংগঠনকে তছনছ করে একটি অপরাধ করেছে। আর এখন কর্মীদেরকে আবার রাজপথে নামার নির্দেশনা দিয়ে হঠকারিতা করে আরেকটি অপরাধ করছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ সব কিছু খেয়ে ফেলা হয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগ সংগঠনের যে হতশ্রী অবস্থা তা চারপাশে তাকালেই বোঝা যায়। একটি সংগঠন টানা পনেরো বছর ক্ষমতায় থাকার পর এই রকম ভগ্নদশা হল কেন, সেই আত্ম অনুসন্ধান আওয়ামী লীগকে করতে হবে সব কিছুর আগে।
Comments
Ismail Hossain Badol
2 months agoজনাব, বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে তিন পরিবারকে দুরে রাখতে হবে। এক. বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ,দুই. বিএনপি, তিন. জাতীয় পার্টি। পরিবারতন্ত্রই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্র বিকাশের প্রধান অন্তরায়। বঙ্গবন্ধুর সময়ে তাঁর সরকার এবং দলে কত জন আত্মীয় স্বজন ছিলো? কেউ কেউ বলে থাকেন,জাসদ বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলো।বিশেষতঃ ন্যাপ কমিউনিস্টের লোকেরা। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের ভাঙ্গনের জন্য শেখ ফজলুল হক মনির বাড়াবাড়িই প্রধান কারণ।বঙ্গবন্ধুর ভাগিনা বলে কথা।মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তার বেপরোয়া ভাব মুজিবনগর বা প্রবাসী সরকারকে বিব্রত করতো।শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্ব দখলের উদগ্র বাসনা থেকে জাসদের জন্ম হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন।মণিকে থামিয়ে দেবার সামর্থ্য কি বঙ্গবন্ধুর ছিলো না? তেমনি পরশদের কমিটি বাণিজ্যসহ অন্যান্য অপকর্ম কি শেখ হাসিনা থামাতে পারতেন না? নিজের আত্মীয়স্বজনকে দলে, সরকারের বিভিন্ন জায়গায় বসানো গনতান্ত্রিক মানসিকতা নয়। একইভাবে খালেদা জিয়া কি তারেক রহমানকে হাওয়া ভবন গঠনসহ অন্যান্য অন্যায্য কাজ থেকে বিরত রাখতে পারতেন না? এরশাদও তাঁর স্ত্রী,সন্তান,ভাই এদের দিয়ে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব ও ক্ষমতার গনতন্ত্রায়ন করে যেতে পারেন নি। শেখ হাসিনাসহ তার আত্মীয়স্বজন আজ আওয়ামী পরিবারের লোকজনের কাছে চূড়ান্তভাবে বিশ্বাস হারাতে বসেছে।এমনকি দেশের মানুষও নতুন ভাবনায় ডুবে আছে। তারেক রহমান যেভাবে পরিনত রাজনীতিকের মতো ক্ষমতায় যাবার কৌশল আঁটছে তা কি সজীব ওয়াজেদ জয়ের দ্বারা সম্ভব? সে ইতোমধ্যে ফাউল প্লে করে ফেলেছে। শেখ হাসিনা ও তার দল একা হয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য শরীক রাজনৈতিক শক্তিকেও তার হারিয়ে ফেলেছেন দাম্ভিকতার কারণে। আওয়ামীলীগের দম্ভ,অন্য দল বা ব্যক্তিকে তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা এখনও শেষ হয়নি।বরং সুবিধাবাদী, লুটেরারা আজও ভাবছে,শেখ হাসিনা নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসবেন এবং আবারও তিনি তাদের মুখে ফিডার তুলে দিবেন।ওরা নতুন উদ্যোমে আবারও নাদুস নুদুস হয়ে উঠবে।আর শেখ হাসিনা কোন কালেই মরবেন না।তার যেন স্বাভাবিক মৃত্যুও হবেনা।বয়সটার কথাও হিসেবে আনেনা আহাম্মকরা। এখন সময়ের দাবী মুক্তিযুদ্ধ,বাঙালি ও বাংলাদেশের পক্ষে নতুন লড়াকু রাজনৈতিক নেতা ও শক্তির উত্থান।যে শক্তি মৌলবাদের হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের সমান বাংলাদেশকে গড়তে এ ব-দ্বীপকে উদ্ধার করবে।আমরা সেই রাজনৈতিক নেতা ও শক্তির প্রসব চিৎকার শুনতে চাই।
Leave a Comment