Post Thumbnail

শেখ হাসিনার পর আসাদের পতন: বিশ্ব কি বার্তা পাচ্ছে?


বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের ঠিক চারমাস পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ পালিয়ে গেছেন। এর মধ্য দিয়ে আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটলো। এই পরিবারের শাসন শুরু হয়েছিলো সত্তরের দশকের শুরু থেকে। সিরিয়ার বিদ্রোহী যোদ্ধাদের দামেস্কে প্রবেশ প্রবেশ এবং ব্যাপক আক্রমণের মুখে ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে দামেস্ক ছেড়েছেন আসাদ। তবে দামেস্ক ছাড়লেও আসাদ কোথায় গেছেন, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। কয়েক দিন আগেই আসাদের পালিয়ে যাওয়ার গুঞ্জন উঠলেও তা অস্বীকার করেছিল দেশটির সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহামেদ আল-রহমুন রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দাবি করেছিলেন যে দামেস্কের চারপাশে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সামরিক বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। এই প্রতিরক্ষা রেখা কেউ ভেদ করতে পারবে না। কিন্তু প্রবল প্রতিরোধের মুখে শেষ পর্যন্ত গুঞ্জনই সত্যি হলো। আসাদ দামেস্ক ছেড়েছেন। আজ রোববার সকালে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাতে বিবিসির সরাসরি সম্প্রচারে আসাদের দামেস্ক ছাড়ার খবর প্রচার করা হয়েছে। এর আগে বার্তা সংস্থা রয়টার্স সিরিয়ার দুইজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে এ তথ্য জানিয়েছে।

উল্লেখ্য যে, বাশার আল-আসাদ ২০০০ সাল থেকে সিরিয়ার ক্ষমতায় রয়েছেন। এর আগে তার বাবা হাফেজ আল-আসাদ ২৯ বছর দেশটি শাসন করেছিলেন। তবে ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। ওই সময় বিক্ষোভকারীদের দমনে কঠোর পন্থা অবলম্বন করেন তিনি। এরপর বিক্ষোভকারীরা সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করেন। এতে করে দেশটিতে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ২০১৫ সালে বাশার আল আসাদকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে রাশিয়া। সে বছর সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল লক্ষ্য করে ব্যাপক বিমান হামলা চালায় তারা। এরপর বিদ্রোহীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলের ব্যাপক হামলার মুখে লেবাননের শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এবং ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে অনেকটা মনোযোগ হারায় সিরিয়া। এ সুযোগ কাজে লাগায় সিরিয়ার বিদ্রোহীরা। তারা আবারও তৎপর হয়ে উঠে। নভেম্বর শেষ দিকে তারা ব্যাপক আগ্রাসী হয়ে উঠে এবং প্রতিরোধের মুখে নাটকীয়ভাবে দামেস্ক ছাড়লেন ‘স্বৈরাচার’ শাসক প্রেসিডেন্ট আসাদ। আসাদের দেশ থেকে পালানোর ঘটনাকে ‘জালিম মুক্ত’ ঘোষণা করেছে সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী। বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নামের একটি ইসলামিক সশস্ত্র গোষ্ঠী দাবি করেছে যে, আসাদের দামেস্ক ছেড়ে যাওয়ার মাধ্যমে একটি অন্ধকার যুগের অবসান ঘটেছে, এবং এক নতুন যুগের সূচনা ঘটেছে। আসাদের দামেস্ক ছাড়ার খবরে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটির রাজধানীতে রাস্তায় নেমে এসেছেন হাজার হাজার মানুষ। তাদের উল্লাস প্রকাশের পাশাপাশি ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা গেছে। 

সাম্প্রতিক সময়ে একই রকম ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। ছাত্র-জনতা ব্যাপক আন্দোলনের মুখে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা। এর কয়েকদিন আগে তার দেশ ছেড়ে পালানোর গুঞ্জন উঠে। তবে তিনি সে সময় এমন গুঞ্জনকে দৃঢ়চিত্তে অস্বীকার করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করার অভিযোগ রয়েছে। দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ সহ নানা রকম অভিযোগ রয়েছে তার সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশে যে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের পর আন্দোলনকারীরা নতুন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় স্বাধীনতার কথা বলেছেন। সিরিয়ায় আসাদের পিতা হাফিজ আল-আসাদ ১৯৭০ সালে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলেও ২০০৯ সালে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ট নিয়ে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা। কিন্তু ধীরে ধীরে তার বিরুদ্ধে স্বৈর শাসনের অভিযোগ দৃঢ় হতে থাকে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে এই অভিযোগ আরও বিস্তৃত লাভ করে। এক বিপ্লবের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পতনে হলেও অনেকে এর পেছনে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর কথা বলছেন। যারা এই বিপ্লবের নেপথ্যে থেকে কাজ করেছেন। বিপ্লবে রসদ জুগিয়েছেন। আর ক্ষেত্রে সবার আগে হিজবুত তাহরীর’র নাম আসে। পাশাপাশি দেশের ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেও দায়ী করছেন কেউ কেউ। 

আওয়ামী লীগের শাসনামল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এ সময় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা তৈরি হয়। আর এই অনাস্থা তৈরি পেছনের কারণ হলো ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকল ক্ষমতার উৎস যেখানে জনগণ, সেখানে জনগণকেই উপেক্ষা করা হয়েছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারই পরবর্তীতে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিত্য নতুন আইন সংযোজন করছে। যা মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেছে। ফলে মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে হতাশা তৈরি হয়েছে। এই সুযোগ লুফে নিয়েছে বিদ্রোহী উগ্রবাদী গোষ্ঠী। এ সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠে ব্যাপক ভাবে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন করে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাঁধাগ্রস্ত করা হয়েছে। দুর্নীতি, লুটপাট ও হয়েছে লাগামহীন ভাবে। সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছেন। ফলে অর্থনীতির ওপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পরেছে। যা সরকারের বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। উগ্রবাদ গোষ্ঠী এই সুযোগে সংগঠিত হয়েছে।

এদিকে মঙ্গলবার গভীর রাতে সামরিক আইন ঘোষণা করেছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল। যদিও পরবর্তীতে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে এ নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া রাজনীতি অস্থিরতার মধ্যে পরেছে। এখন তিনি অভিশংসনের মুখোমুখি হয়েছেন। এভাবে দেখা যাচ্ছে দেশে দেশে এখন মানুষ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন। এর একটি কারণ হতে পারে যে, শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে মানুষ উগ্রবাদের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। আপাতত দৃষ্টিতে এটাকে গণতান্ত্রিক মনে হলেও বাস্তবতা হলো দেশে দেশে উগ্রবাদ গোষ্ঠীর তৎপরতা বেড়েছে, তাদের ভিত্তি মজবুত হচ্ছে এবং সাংগঠনিক শক্তি বিস্তৃতি লাভ করছে। যেখানে রাষ্ট্র তাদের কাছে দুর্বল হয়ে পরছে। এরকম বাস্তবতায় সিরিয়ার আসাদ এবং বাংলাদেশের শেখ হাসিনার পলায়ন বিশ্বকে কি বার্তা দিচ্ছে সেটি একটি বড় প্রশ্ন।


Comments

Leave a Comment


Related Articles