Post Thumbnail

ভারত: বন্ধু তুমি, শত্রু তুমি


ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর মুখ থুবড়ে পড়েছে ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক। এ সময় বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে নানা রকম প্রতিক্রিয়া ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে দু দেশের মধ্যে। মাঝে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল বটে কিন্তু সেটিও আশার আলো দেখেনি। সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের কথা চাউর হলেও শেষ পর্যন্ত সেটি হয়নি। যদিও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে দু দেশের এই কূটনীতিক একমত হলেও বস্তুত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে বরফ গলার কোন আলামত এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। সাম্প্রতিক সময়ে আবার নতুন করে দু দেশের মধ্যে উত্তেজনা লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার এবং বাংলাদেশে ভারতের জাতীয় পতাকা অবমাননার ঘটনায় দু দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ফের নতুন করে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে দুই দেশই পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। পরস্পরের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযোগ তুলেছে। এ রকম ঘটনার প্রতিবাদে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কলকাতার একাধিক চিকিৎসক ও বেসরকারি হাসপাতাল। 

এদিকে অভ্যুত্থানের পরপর থেকেই দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ভিসা সেন্টারগুলো বন্ধ থাকার পর সীমিত পরিসরে কার্যক্রম শুরু হলেও এখনো ভিসা না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। যদিও ভারত জানিয়ে দিয়েছে যে চিকিৎসার জন্য ভিসা এবং কিছু জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অন্যান্য ভিসা তারা ইস্যু করবে না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্যও ভিসা পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর ভারতীয় ঋণে চলমান বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। এ সমস্ত ঠিকাদার এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। নতুন ভারতীয় কোন বিনিয়োগ তো আসেনি বরং উল্লেখ্যযোগ্য ভাবে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য কমেছে। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে শুধু আগস্ট মাসেই বাংলাদেশে ভারতের রফতানি এক লাফে প্রায় ২৮ শতাংশ কমেছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশেও ভারতবিরোধী প্রচারণা বা ভারত বিদ্বেষী কমকাণ্ড এখনো অব্যাহত রয়েছে। ভারতের জাতীয় পতাকা অবমাননার চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সয়লাব হয়ে গেছে। প্রথম আলো-ডেইলি স্টার পত্রিকাকে ভারতের আগ্রাসণ নীতি বাস্তবায়নের কারিগরি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে এবং এই দুটি গণমাধ্যম অফিসের সামনের বিক্ষোভের ঘটনা ভারতবিরোধী প্রচারণাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোও ভারতের আগ্রাসণ নীতির সমালোচনা করছে। যদি ভারতের পক্ষ থেকে এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। ওদিকে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার পরপর দুই দিন ভারতের লোকসভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু প্রসঙ্গটি ওঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করেছে ভারতের শাসকদল বিজেপি-সমর্থিত স্থানীয় একটি গোষ্ঠী। বিক্ষোভকারীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে মিশনের সামনে চলে আসে। পোড়ানো হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কুশপুত্তলিকা। সবকিছু মিলিয়ে ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন অগ্নি গর্ভে। অথচ ভারত বাংলাদেশের বন্ধু প্রতীম দেশগুলোর অন্যতম একটি। সেই বন্ধুই এখন আবার শত্রু হিসেবে চিত্রিত হচ্ছে।

উল্লেখ্য যে, গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ শাসনামলে ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। দু দেশের পক্ষ থেকে এই সম্পর্ককে ঐতিহাসিক হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে বারবার। টানা ১৫ বছরের শাসনামলে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে দুই দেশের শীর্ষ ব্যক্তিরাই সোনালি অধ্যায় বলেছেন। আরও নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার অঙ্গিকার ছিল দুই দেশের। এ সময় দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে কোন পক্ষ থেকে অস্বস্তি লক্ষ্য করা যায়নি। যদিও কোন কোন ইস্যুর ব্যাপারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এই সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন মহলে অস্বস্তি ছিল, বিতর্ক ছিল। বিশেষ করে সীমান্ত হত্যা এবং বাংলাদেশে ভারত আগ্রাসণ নীতি অনুসরণ করছে বলেও বিভিন্ন মহল থেকে নানা সময় অভিযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু এ সমস্ত বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে দুই দেশই সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিল। সম্পর্ক এগিয়ে নিয়েছিল এবং এই সম্পর্ককে একটি সরল সমীকরণে উপনীত করতে সক্ষম হয়েছিল দুই দেশই। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর দুই দেশের সম্পর্ক রাতারাতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নিবে সেটা নিয়ে এখন অনিশ্চিয়তা তৈরি হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি ভারত হয়তো সহজে মেনে নিতে পারছে না। এটা অনুধাবন করতে কিংবা মানিয়ে নিতে ভারতের সময় লাগছে। কারণ বিগত সময়ে ভারত এই সম্পর্কে একটি স্বস্তিদায়ক অবস্থানে ছিল। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ভারত যেসব সুবিধা পেয়েছে সেগুলোর বিষয়ে তারা এখন এক ধরনের অনিশ্চয়তায় ভুগছে। তবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কোন একটি ইস্যুতে আটকে থাকে না বলেও অভিমত কূটনীতিক বিশ্লেষকদের। এক্ষেত্রে বর্তমান বাস্তবতায় হয়তো একটু সময় লাগবে। ভারত হয়তো সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। কারণ কূটনৈতিক সম্পর্কই হলো স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে দুই দেশেরই স্বার্থ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এখানে বাংলাদেশের যেমন স্বার্থ আছে, তেমনি ভারতের স্বার্থও জড়িত। এছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে গভীর ও বহুমাত্রিক। এ দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক বিভিন্ন দিক থেকে প্রভাবিত হয়। সুতরাং অনাকাঙ্খিত ঘটনাগুলোকে পাশ কাটিয়ে পারস্পরিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়াটাই উত্তম বলে মনে করেন বিশ্লেষরা। দুই দেশের মানুষের এমন অনেক ইস্যু আছে, যেগুলো ফেলে রাখার সুযোগ নেই। এমন অবস্থায় ভালো প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক এগিয়ে নিতে কাজ করার সুযোগ আছে। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে ধরনের ইঙ্গিত লক্ষণীয় নয়। তবে ভারতে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান যে এই সম্পর্কে বারবার অস্বস্তি সৃষ্টি করবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ ভারতে অবস্থান করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বক্তব্য-বিবৃতি দেয়ার বিষয়টি ভালো চোখে দেখছে না ঢাকা। বিষয়টি এরই মধ্যে দিল্লিকে অবহিত করেছে ঢাকা। ফলে পারস্পরিক স্বার্থ সিদ্ধি জড়িত থাকলেও সহসাই যে এই সম্পর্কের বরফ গলবে তা কে হলফ করে বলতে পারবে। এখন দেখার বিষয় শেষ পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।


Comments

Leave a Comment


Related Articles