একুশে আগস্ট কিছুই ঘটেনি?
শান্ত সিংহ: বহুল আলোচিত একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত পুরো মামলার প্রক্রিয়া বিবেচনায় নিয়ে এই রায় দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কি ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে কিছুই ঘটেনি?
আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার ছিল অবৈধ। আইনে এটা টেকে না। রায়ে আরও বলা হয়েছে, যে চার্জশিটের ভিত্তিতে নিম্ন আদালত বিচার করেছিলেন তা আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই মামলার বিচার যদি অবৈধই হতো কিংবা এর যদি আইনগত গ্রহণযোগ্যতা না থাকতো তাহলে উচিত ছিল এই মামলার পুনঃতদন্ত করা। একটি নির্মোহ তদন্ত প্রক্রিয়ার শেষে সুষ্ঠু বিচার করার মধ্য দিয়ে এর সুরাহা করা। কারণ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক বিতর্ক আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজকের যে সংঘাত তার সূচনাই হয়েছিল একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা দিয়ে।
এটিও অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, শুরু থেকে এই মামলার বিচারকার্য নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ২০০৪ সালে এই ঘটনার সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বিএনপি সরকার। আওয়ামী লীগের অভিযোগ একুশে আগস্ট হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা ছিল। আর এই ষড়যন্ত্রে তখনকার সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র জড়িত। রাষ্ট্রীয় মদদে এই হামলার ষড়যন্ত্র হয়েছে। এই অভিযোগ পাকাপোক্ত হয় হামলার ঘটনার পরে যেভাবে তদন্তের নামে ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজানোর মাধ্যমে মামলা ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করা হয় এবং সেই সময়ের বিএনপি নেতারা যেসব মন্তব্য করেছে, সেসব কারণে বিএনপির আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরবর্তীতে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর হামলার ঘটনা পুনঃতদন্ত শুরু হয়। এই ঘটনায় ওই সরকার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পেয়েছিল। মামলার আরও নতুন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। ঘটনা নতুন করে মোড় নিয়েছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার তদন্ত শুরু করা হয়। ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি আবদুল হান্নানকে গ্রেপ্তার করা হয়ে। তার জবানবন্দির পরে পুরো মামলা ভিন্ন চেহারায় রূপ নেয়। সে সময় আদালতে উপস্থাপিত মুফতি হান্নানের জবানবন্দিতে বলা হয়, বিএনপি সরকারের শীর্ষ কয়েকজন ব্যক্তির সহায়তায় তিনি আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে রায়ে আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতেই একুশে অগাস্টের হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে এবং এই হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রযন্ত্র জড়িত ছিল বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছিল। সে সময় জজ আদালত এ মামলায় ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছিল। এখন ২০২৪ সালে বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করে সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।
উল্লেখ্য যে, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি কলঙ্ক অধ্যায়। বাংলাদেশের আজকের যে বিভাজনের রাজনীতির তার সূত্রপাতই হয়েছে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আগে থেকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও একুশে অগাস্টের ঘটনায় দুই দলের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস আর চরম তিক্ততা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক সেই ফাটল পরবর্তীতে আরও দীর্ঘ হয়েছে, স্থায়ী হয়েছে। যা এখনো বহমান রয়ে গেছে।
এখন বাংলাদেশ নতুন করে বিনির্মাণের কাজ চলছে, সংস্কার চলছে। নতুন এই বাংলাদেশে কেউই রাজনৈতিক কোন সংঘাত চায় না বলে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গিকার করেছে। নতুন ধারার রাজনীতি করার কথা বলছেন বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ। কিন্তু একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার আজকের এই রায়ে রাজনৈতিক সংঘাত দূর হবে কিনা সেই প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে। হাইকোর্ট আজ এই মামলার সব আসামীকে খালাস দিয়েছে। তবে আরও ভালো হবে এখন যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উদ্যোগী হয়ে একটি নির্মোহ পুনঃতদন্ত করে। যেখানে দুই পক্ষের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সন্দেহ দূর হবে। কারণ এই মামলা নিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির অবস্থান বিপরীত এবং দল দুটির এই বিপরীত অবস্থানই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংঘাত, হানাহানির সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে। সেজন্য এ ঘটনার একটি নির্মোহ তদন্ত হওয়া আবশ্যকীয়। বিএনপির অভিযাগ একুশে গ্রেনেড হামলার মামলায় দলটিকে রাজনৈতিক ভাবে হয়রানি করা হয়েছে। এর সঙ্গে তাদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের অভিযোগ ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের মাধ্যমে বিএনপি আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতেই একুশে আগস্ট পরিকল্পিত ভাবে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকার যদি এই মামলা নতুন করে পুনঃতদন্ত করা উদ্যোগ নেয় এবং একটি নির্মোহ তদন্ত শেষে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করে তাহলেই প্রকৃতপক্ষে এর সুরাহা হবে। পরস্পরের প্রতি দু দলের যে সন্দেহ তা দূর হবে। বাংলাদেশও সংঘাতের রাজনীতি থেকে মুক্তি পাবে। অনথায় আমাদের এই সংস্কার প্রক্রিয়া অচিরেই আবার মুখ থুবড়ে পড়বে। ক্ষমতার পালা বদল হলে আবার নতুন করে মামলার বিষয়টি উঠে আসবে। এতে করে আমাদের রাজনীতিতে সংঘাত এবং বিভাজন থেমেই যাবে। আর সেরকম পরিস্থিতি আমরা কেউই চাই না।
Comments
Leave a Comment