বিবর্ণ ডিসেম্বর!
শুরু হয়েছে বাঙালি জাতির গৌরবের মাস ডিসেম্বর। লাখো বাঙালির রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্তি মেলে এই ডিসেম্বরে। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বিজয়ী হয় বাঙালি জাতি। তৎকালীন পূর্ব বাংলার বাঙালিদের দীর্ঘদিনের স্বাধিকারের আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি পায় ডিসেম্বর মাসে। বিশ্বের বুকে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় বাংলাদেশ নামের এক নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র। তবে এর শুরুটা হয়েছিল আরও অনেক আগেই। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হওয়া লড়াই শেষ হয় ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের মাধ্যমে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। এরই পটভূমিতে ১৯৭১ সালে বাঙালি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ত্রিশ লাখ বাঙালির জীবন বিসর্জনের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের দিনটি আসে। তাই বাঙালির হৃদয়ে এ মাস আনন্দের ও গৌরবের। এই মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ করি, শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। এরই মধ্যে দেখতে দেখতে পেরিয়েছে ৫২ বছর। আর কয়েকদিন পরই গৌরবময় বিজয়ের ৫৩ বছর পূর্ণ হবে। কিন্তু এবারের ডিসেম্বর যেন তার চিরচেনা রূপে ফেরেনি। ফিরে অন্যরূপে। এক বিবর্ণ রূপে। বিজয়ের মাস উদযাপিত হচ্ছে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। চারিদিকে কেমন এক অনিশ্চিয়তার ঘনঘোর। অমানিশার অশনি সংকেত।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। এই অভ্যুত্থানে অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। অনেকে আহত হয়েছেন, এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অভ্যুত্থানের পরপরই আমরা অঙ্গিকার করেছিলাম একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের। যেটি হবে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ। কিন্তু অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময় গোটা জাতি এক অজানা আশঙ্কায় শঙ্কিত। গত তিন মাসে সামাজিক অস্থিরতা ছড়িয়ে পরেছে সর্বত্রই। কথায় কথায় বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে সামনে আসছে। দাবি আদায়ে সড়ক অবরোধ করছে, ট্রেনের ওপর হামলা করা হয়েছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের আচরণ গোটা জাতির মধ্যে এক আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প নতুন করে উস্কানি দিচ্ছে। এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলে শিক্ষার্থীদের সচিবালয় ঘেরাও, আনসারের অবরোধ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভুক্ত সাত কলেজকে ‘স্বতন্ত্র পরিচয়’ দেয়ার দাবি, তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি, রিকশা চালকদের অবরোধের ঘটনাগুলো যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল তা রীতিমতো আতঙ্কের। মানুষ এখন ঘর থেকে বের হচ্ছে এক আশঙ্কা নিয়ে। দাবি আদায়ের আন্দোলন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, মানুষ একটি স্বস্তিদায়ক পরিবেশে ঘরে ফিরতে পারবে কিনা সেই আশঙ্কা তাকে তাড়া দিচ্ছে। যদিও গত কয়েকদিন ধরে দাবি আদায়ের আন্দোলন বন্ধ রয়েছে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে যে আবার সেটি ফিরে আসবে না এটি হলফ করে বলতে পারবে কে? ইতিমধ্যে নয় দফা দাবিতে আগামী ৪ ডিসেম্বর (বুধবার) সচিবালয়ে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। যদিও আজ এক সংবাদ সন্মেলনের মাধ্যমে এই মহাসমাবেশ স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর সুরাহা কি হবে সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সচিবালয়েও এনিয়ে এক ধরনের অস্বস্তি রয়েছে। সর্বশেষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় যে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তা রীতিমতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি হওয়ার উপক্রম। যদি সরকার পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। কিন্তু এ ধরনের লাগাতার ঘটনাগুলো জনমনে দিন দিন শঙ্কা সৃষ্টি করছে। যে ডিসেম্বরে আমরা আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস স্মরণ করে নতুন উদ্যোমে উদ্দীপ্ত হই সেই ডিসেম্বর আজ রং চটা, বিবর্ণ।
Comments
Leave a Comment