Post Thumbnail

বিএনপি নয়, আগামীতে ক্ষমতায় আসবে তৃতীয় ধারা?


আওয়ামী লীগ, বিএনপির বাইরে রাজনীতিতে একটি তৃতীয় ধারা উত্থানের চেষ্টা দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশের সুশীল সমাজ, আন্তর্জাতিক শক্তি সহ বিভিন্ন মহল রাজনীতিতে একটি তৃতীয় ধারা সৃষ্টির চেষ্টা করে আসছে বিভিন্ন সময়ে। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছিল। সুশীল সমাজের সহযোগিতায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে জনপ্রিয় করারও প্রচেষ্টা হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণ ফোরামকে রাজনীতির তৃতীয় ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়। কিন্তু গণফোরামের উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আবার ২০০৭ সালে ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর নেতৃত্বে কিংস পার্টি গঠনের চেষ্টা করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপিকে মাইনাস করে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টাও সফল হয়নি। আর সাম্প্রতিক সময়ে আবার রাজনীতিতে তৃতীয় ধারার সৃষ্টির একটি চেষ্টা ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি অচিরেই একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এটি আগামী দিনে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে বলেও অনেকে মনে করেন। অন্তত সরকারের পক্ষ থেকে এই রাজনৈতিক শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হচ্ছে বলে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান। 

এখন বিএনপি কাগজে কলমে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। এই মুহূর্তে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারে। আওয়ামী লীগ এখন ছিন্ন ভিন্ন, লন্ডভন্ড। আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যেই মাইনাস হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরে আসতে দেওয়ার ব্যাপারে ছাত্রদের প্রবল বাঁধা রয়েছে। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোনও রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নেই। নির্বাচনের মাধ্যমে তারা আওয়ামী লীগের কবর রচনা করতে চায়। জনগণই নির্ধারণ করবে যে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতি করতে পারবে কি পারবে না। তবে বিএনপির এই অবস্থানকে ব্যাপক ভাবে সমালোচনা করছেন শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন যে গণহত্যার বিচার এবং অতীত ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না করা পর্যন্ত আওয়ামী লীগের মুক্তি নেই। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার অধিকার নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে যে, আওয়ামী লীগকে কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হবে না। এর প্রেক্ষিতেই রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন কোটি টাকার প্রশ্ন, আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিও কি মাইনাস হবে? যদিও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল একটি সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, বিএনপিকে মাইনাস করা এতো সহজ নয়। ২০০১ এর বিএনপি আর বর্তমান বিএনপি এক নয়। তিনি মনে করেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপি ব্যাপক ভোটে বিজয়ী হবে। বিএনপি নেতা-কর্মীরা এই কারণেই এখন নির্বাচনমুখী। দ্রুত নির্বাচনের জন্য তারা সরকারের প্রতি বারবার আহ্বান জানাচ্ছে। এখন তারা একটু চাপও সৃষ্টি করছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনও রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। বরং বলা হচ্ছে যে, সংস্কারের রিপোর্টগুলো পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে নির্বাচনের ব্যাপারে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। তবে নির্বাচন পেছানোর পেছনে একটি রাজনৈতিক মেরুকরণ রয়েছে বলে কোনও কোনও বিশ্লেষকের ধারণা। ইতিমধ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটি আত্মপ্রকাশ করেছে। গতকাল নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় পরিধি বিস্তৃত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে সারজিস আলমকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারা দেশে কমিটি করছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং নাগরিক কমিটির মধ্যে এখন স্পষ্ট একটা সেতুবন্ধন রাখা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যারা নাগরিক কমিটি আছে, তারা অনেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সারজিস আলম আবার জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের একজন নেতাও বটে। অর্থাৎ সরকারের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। বর্তমান সরকারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন উপদেষ্টা রয়েছেন। এই দুজন উপদেষ্টাও এখন অনেক প্রভাবশালী। ফলে নাগরিক কমিটি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য ক্রিয়াশীল শক্তিদের সমন্বয়ে একটি রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রক্রিয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এখন ক্রমশ এই রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে। নির্বাচন যত পেছাবে তত এই জাতীয় নাগরিক কমিটি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাংগঠনিক ভিত্তি শক্তিশালী হবে। ইতিমধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশের ১৮ টি জেলায় কমিটি করেছে। বাকি জেলাগুলোতেও কমিটি করা হবে। তারা ৫ আগস্টের আন্দোলনের পর এখন পর্যন্ত মাঠে ছেড়ে যায়নি। বরং বিভিন্ন বিষয়ে তারা নিয়মিত কথাবার্তা বলছে। রাষ্ট্র সংস্কারের ব্যাপারে তাদের সুস্পষ্ট অবস্থানও তারা বর্ণনা করছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাদের নিয়োগকর্তা হিসেবে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ সরকারের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটা নৈকট্য রয়েছে আবার জাতীয় নাগরিক কমিটি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরই একটি অংশ হিসাবেই কাজ করছে। অর্থাৎ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গঠনের প্রচেষ্টা এখন বেশ জোরেশোরেই দেখা যাচ্ছে। এই রাজনৈতিক শক্তি কবে, কীভাবে আত্মপ্রকাশ করবে সেটিই এখন দেখার বিষয়। 

অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন যে, এটি হবে রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি। বিশেষ করে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্রসমাজের একটা ব্যাপক পরিচিতি তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের একটা জনপ্রিয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তারা একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চায়। আগামী নির্বাচনে যদি জাতীয় নাগরিক কমিটি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অংশগ্রহণ করে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তারা যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া করছেন সেটি বিএনপির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে আসতে পারে। সরকার যদি এই তৃতীয় ধারাকে সমর্থন দেয় এবং আন্তর্জাতিক মহল থেকেও যদি তৃতীয় ধারার প্রতি সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হয়, তাহলে আগামী নির্বাচনে নাটকীয় ঘটনা ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। 

বিএনপি যে এ ব্যাপারে কোনও ইঙ্গিত পায়নি তা নয়। বিএনপির অনেক নেতাই মনে করছেন যে, এখনও রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এই ষড়যন্ত্রের রূপ অবয়ব সম্পর্কে তারা ব্যাখ্যা না দিলেও বিএনপি নেতাদের সাথে একান্ত আলাপ করলে বোঝা যায় যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো মাইনাস ফর্মুলা যে চলমান সে সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল। তারা মনে করেন যে, আওয়ামী লীগকে মাইনাস করার পর এখন বিএনপিকেও ক্ষমতায় আসতে না দেওয়ার একটি নীলনকশা বাস্তবায়ন চলছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া এখনো বিদেশ থেকে দেশে ফেরেননি। বিএনপির বিভিন্ন নেতার বিরুদ্ধে যে সমস্ত মামলাগুলো হয়েছে, সেই সমস্ত মামলাগুলো প্রত্যাহারের ক্ষেত্রেও এক ধরনের ঢিলেঢালা ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মামলাগুলো নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত আশানুরূপ অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। বিএনপির কোনও কোনও নেতা বলেছেন যে, একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমেই তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে সব মামলা বাতিল করা যায়। কিন্তু এই জায়গায় অস্পষ্টতা রয়েছে। কারও কারও মতে, তারেক জিয়াকে দেশে আসার কোনও সবুজ সংকেত দেয়া হয়নি। 

সরকার এখন পর্যন্ত বিএনপির সাথে সহমর্মিতা এবং সহযোগিতামূলক আচরণ করে যাচ্ছে। কিন্তু এই সহমর্মিতা এবং সহযোগিতা কতদিন থাকবে সেটি একটি বড় বিষয়। এই সরকারকে বিদায় নেওয়ার আগে একটি সম্মানজনক এক্সিট রুট তৈরি করতে হবে। আগামী জাতীয় সংসদে এই সরকারের সমস্ত কর্মকাণ্ড গুলোকে বৈধতা দিতে হবে। আর সে কারণেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়তো রাজনীতিতে একটি তৃতীয় শক্তিকে স্বাগত জানাতে চাইছে। অতীতে দেখা গেছে যে, যারাই একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে সংবিধানের বাইরে গিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে, তারাই একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়েছে। জিয়াউর রহমান সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা গ্রহণ করে বিএনপির জন্ম দেন। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক শাসন জারি করে জাতীয় পার্টির জন্ম দেন। এই ধারায় এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাত্রদের দিয়ে রাজনৈতিক দল তৈরি করবে কিনা তা নিয়ে এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা। বিশেষ করে এটি বিএনপির মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন যে, বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে না দিয়ে ছাত্রদেরকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য একটা নীলনকশা আছে। তবে সেই নীলনকশা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না বলেও বিএনপি নেতা দাবি করেছেন। সম্ভব, অসম্ভব পরের বিষয় কিন্তু রাজনীতিতে যে একটি নতুন শক্তির আবির্ভাব হচ্ছে তা জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড থেকে বোঝা যায়। এখন দেখার বিষয় যে এই নতুন রাজনৈতিক বিন্যাস বিএনপির সাথে কতটুকু সংঘাতে জড়ায়। বিএনপি এই নতুন রাজনৈতিক উত্থানকে কিভাবে গ্রহণ করে। কারণ বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত মনে যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা জাতীয় নাগরিক কমিটির অবয়র নতুন একটি কিংস পার্টি গঠনের চেষ্টা, তাহলে বিএনপি তার প্রতিবাদ করবে। সেই প্রতিবাদ করতে গেলে রাজনীতিতে আরেকটি নতুন সঙ্কট সামনে এসে দাঁড়াবে।


Comments

User Avatar

Ali

1 month ago

You are right ✅️

Leave a Comment


Related Articles