Post Thumbnail

‘কেষ্ট বেটাই চোর’


বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীনদের দায় এড়ানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’। বাংলাদেশের ৫৩ বছরের রাজনীতির ইতিহাসে যারা যখন ক্ষমতায় এসেছে তাদের ‘মহা ঔষধ’ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে এই দায় চাপানো বটিকা। যারা সরকারে থেকেছে, দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, তারা এই ব্যর্থতার কারণ ঢাকতে এই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ সামনে এনেছে। সবসময় ক্ষমতাসীন সরকারে কাছে একটি অব্যর্থ অজুহাত হলো এটি। যে কোনও সমস্যা হলেই তারা বলে এটি বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র। সরকারকে বিপদে ফেলার ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই এই ধারা আমরা দেখে আসছি। 

২০২৪ এর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ ‘নতুন স্বাধীনতা’ পেয়েছে বলে দাবি করা হয়। ‘নতুন স্বাধীনতা’র ফসল হিসেবে নতুন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এই নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে সমস্ত বিভেদ ভুলে ‘বাংলাদেশকে একটি পরিবার’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। কিন্তু এই ঐক্যের মধ্যে বিভক্তি আর প্রতিহিংসার এক বীভৎস রূপ জাতি প্রত্যক্ষ করেছে গত প্রায় ৪ মাস সময়। এর মধ্যেই একটি অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করা যাচ্ছে এই সরকার সবকিছুকেই বদলে দিতে চাইলেও পুরোনো বদঅভ্যাস গুলো ঠিকই আগলে ধরে আছে। নিজেদের সংকটগুলো, নিজেদের ব্যর্থতাগুলো ঢাকতে তারা ষড়যন্ত্রের ঢালকে ব্যবহার করছে ঠিক একই ভাবে। আয়নায় নিজের চেহারা দেখছে না। সবকিছুতেই ‘ষড়যন্ত্রের ভুত’ আবিষ্কারের নেশা।

আওয়ামী লীগ সরকার তার শেষদিকে এসে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’কে ব্যাপক প্রয়োগ করেছিল। সব কিছুর মধ্যে তারা ষড়যন্ত্র খুঁজেছিল। কোটা আন্দোলনে যখন শিক্ষার্থীরা রাজপথে নামলো, তখন সেই আন্দোলনের সহজ সমাধানে না গিয়ে তার মধ্যে ষড়যন্ত্র খুঁজেছিল। শিক্ষকরা যখন নতুন পেনশন স্কিমের বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছিল, তখন তার মধ্যেও ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পেয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এমন কি যখন আদালতে এটির শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ ছিল তখনও ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ সামনে এনে মূল সমস্যাকে পাশ কাটানো প্রবণতা ছিল ভয়ংকর ভাবে। এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের কিছু মন্ত্রী যেন ষড়যন্ত্র আবিষ্কারের জন্য রীতিমতো ল্যাব খুলে বসেছিলেন। সবকিছুর মধ্যে তারা ষড়যন্ত্র খুঁজতেন। বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, লঞ্চ ডুবি কিংবা অর্থপাচার সবকিছুই জন্যই বিরোধী দলের ষড়যন্ত্রকেই দায় করার এক অদ্ভুত ব্যাধি ক্ষমতাসীন দলকে আক্রান্ত করেছিল। এমনকি আওয়ামী লীগের গঠনমূলক সমালোচনাকেও দেশ বিরোধী চক্রান্ত বলা হতো। আর এই কারণেই মূল সমস্যা সমাধান করার দিকে তৎকালীন সরকার মনোযোগী হয়নি। মূল সমস্যাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যা কিছুই হচ্ছে তার মধ্যে ষড়যন্ত্র আবিষ্কারে এক উন্মত্ত নেশা পেয়ে বসেছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের মাঝে। ধরা যাক, সোমবার ভোরবেলা শাহবাগে বাস ভর্তি করে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক জড়ো হয়েছিল। এই লোকগুলো কেন জড়ো হয়েছিল এই নিয়ে পাওয়া যাচ্ছে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য। যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদেরকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা জোনায়েদ সাকি। তিনি সেখানে বলেছেন, এটি ভুল বোঝাবুঝি। বিদেশে যে সমস্ত অর্থপাচার করা হয়েছে, সেই পাচারকৃত অর্থগুলোকে উদ্ধার করে মানুষকে বিনা সুদে ঋণ দেওয়ার দাবীতে শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাবেশ গ্রহণ করা হয়েছিল বলেই তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন।

অন্যদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, এটি ছিল সরকারকে উৎখাত করার এক গভীর ষড়যন্ত্র। এখন আমরা সাধারণ নাগরিকরা কোনটা বিশ্বাস করবো? শুধু তাই নয়, ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব দেওয়া হয়েছে তিন কলেজের সহিংসতার ঘটনাকেও। বলা হচ্ছে, সরকার উৎখাতে এটি ‘সুগভীর ষড়যন্ত্র’। এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর একের পর এক বিভিন্ন রকম ঘটনা ঘটেছে। আনসারদের দাবি দাওয়া নিয়ে সচিবালয়ে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছিল। এই বিক্ষোভে পেছনে আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র খুঁজে পেয়েছিলেন ক্ষমতাসীন সরকারের লোকজন। তারা এই সমস্ত আনসারদেরকে পিটিয়ে ঠান্ডা করেছেন, অনেকে গ্রেপ্তার করেছেন। তাদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘আনসার লীগ’। যে আওয়ামী লীগ পালিয়ে কুল পাচ্ছে না, যে আওয়ামী লীগ নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই বিপন্ন, তারা যদি আনসারদেরকে সংগঠিত করতে পারতো তাহলে তো ৫ আগস্টের এই গণ-অভ্যুত্থানই হতো না। বিভিন্ন জিনিস পত্রের দাম এখন আকাশ ছোঁয়া। মানুষের মধ্যে হাহুতাশ বাড়ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে মানুষের অস্বস্তি এখন ক্ষোভে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেও ক্ষমতাসীন দলের কেউ কেউ ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। তারা মনে করছেন যে, এটি হলো ‘ফ্যাসিবাদী’ শক্তির ষড়যন্ত্রের অংশ। আওয়ামী লীগ ষড়যন্ত্র করে জিনিসপত্রের দাম কৃত্রিম ভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের অনেকে অভিযোগ করেছেন। বাহ! কি চমৎকার কথা, আওয়ামী লীগ যদি এতোই চতুর এবং একটি দক্ষ রাজনৈতিক দল হতো তাহলে তো এতোদিনে নিজেদের অত্যন্ত অস্তিত্বটুকু জানান দিতো। সারা দেশে খুন রাহাজানিতে সয়লাব হয়ে গেছে। প্রতিদিন বিভিন্ন রকম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। কেউ নিরাপদ নয়, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ অবনতি। পুলিশ পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। কারণ ৫ আগস্টের পর থেকে পুলিশের মনোবল পুরোপুরি ভেঙে গেছে। অনেক পুলিশ চাকরিতে যোগ দেয়নি। পুলিশের গাড়ি, সরঞ্জাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক থানায় এখন পর্যন্ত বসার মতো উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। এই অবস্থায় পুলিশ পুনর্গঠনের চেয়ে পুলিশের মধ্যে আওয়ামী লীগ খোঁজা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, পুলিশের কিছু কিছু অংশ এখনও ফ্যাসিবাদের দোসর। তারা নানা রকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। পুলিশে প্রশিক্ষণ শেষ করা বহু তরুণের চাকরী চলে গেছে সরকারের ষড়যন্ত্র ফোবিয়ার কারণে।

প্রশাসনের দিকে তাকালেও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ব্যাপক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। প্রশাসনে এখনো নাকি ফ্যাসিবাদের দোসররা ঘাপটি মেরে বসে আছে। তারা নাকি সব কিছু অচল করে দিচ্ছে। সবকিছু যদি তারা অচলই করে দেবে তাহলে পরে গণ-অভ্যুত্থান কেন? গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাদের কাজ কি? প্রশাসনে ১২ বছর আগে অবসর নেওয়ার লোকজনকে নিয়ে এসে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা নতুন পদ্ধতির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। এই সমস্ত অবসর প্রাপ্ত লোকজন প্রশাসনিক কাজে কতটুকু গতি নিয়ে আসবে সেটি নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি যারা এতোদিন বঞ্চিত ছিলেন, যোগ্যতার থাকার সত্ত্বেও সচিব হতে পারেনি, পদোন্নতি পাননি, তারাও এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এটির মধ্যে আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র খুঁজে পাওয়া নিশ্চয় একটি রীতিমতো আবিষ্কারের বিষয়। ষড়যন্ত্র এখন কোথায় নেই? সরকারের লোকজন যে সমস্যা গুলোই সামনে পাচ্ছেন, সেই সমস্যা গুলোকেই যৌক্তিকভাবে সমাধানের চেয়ে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ করে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন। এ যেন ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলে কেষ্ট বেটাই চোর।’ 

আওয়ামী লীগ সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। সাড়ে ১৫ বছর অনেক ভুল কাজ করেছে এবং ভালো কাজও করেছে। ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগকে সমূলে রীতিমতো উৎপাটন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নাম উচ্চারণ করাও এখন রীতিমতো পাপের পর্যায়ে পরে। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ বিভিন্ন জায়গায় ষড়যন্ত্র করবে এমন ভাবাটা হলো মূল সমস্যাটাকে পাশ কাটানো এবং সংকটকে আলিঙ্গন করা। আসলে যে জায়গাগুলোতে সংকট হচ্ছে সেই সংকটগুলোকে নির্মোহ ভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। সংকট সমাধানের উপায় বের করতে হবে। তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘাতের কথাই ধরা যাক না কেন, এই সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে গত জুলাই থেকে শিক্ষার্থীদের যে ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে। শিক্ষার্থীরা ৫ আগস্টের পর থেকে মনে করেছে জোর করে রাজপথে নেমে, রাজপথ বন্ধ করে দিলে কিংবা শক্তি প্রয়োগ করলে সব দাবি আদায় করা সম্ভব। সেটা তারা করেছেও। তারা এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে দেয়নি। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত, অপমানিত করে তাদের পদত্যাগে বাধ্য করেছে। তারা মনে করছে যে, দেশে কোনও প্রচলিত আইন নেই, শক্তি প্রয়োগই একমাত্র আইন। আর এই কারণেই ছোট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা শক্তি প্রয়োগ করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে যাই বলা হোক না কেন, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ এখন একটি ঝুঁকিপূর্ণ সহিংস পথকেই তাদের সংকট থেকে উত্তরণের পথ হিসাবে মনে করেছে। 

যে কোনও সংকট সমাধানের জন্য আসলে সমস্যার গভীরে যেতে হবে। সংকটকে বুঝতে হবে, বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। তা নাহলে এই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ দিয়ে সাময়িকভাবে মানুষের দৃষ্টিকে অন্য দিকে সরানো যাবে বটে কিন্তু সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এর ফলে জনঅসন্তোষ বাড়তেই থাকবে। শেষে সত্যিই যখন ষড়যন্ত্র হবে তখন জনগণ মনে করবে, ‘সরকারী প্রোপাগান্ডা’। রাখল বালকের ‘বাঘ মামা’র গল্পটা মনে আছে তো?


Comments

User Avatar

Nayeem

1 month ago

Perfect analysis but who cares! Thank you so much for the article.

Leave a Comment


Related Articles