বাংলাদেশ কি সিরিয়া হচ্ছে, না আফগানিস্তান?
রোববার ঢাকা শহরে প্রথম কর্মদিবস ছিল উত্তপ্ত ও সহিংসতায় ভরপুর। রোববার যদি ঢাকা সহিংসতার শহর হয়, তাহলে সোমবার ছিলো তাণ্ডবের শহর। পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, ডেমরায় যা হয়েছে তা অবর্ণনীয়। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে নির্বিচারে। পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে কাওরান বাজার কোথায় সহিংসতা নেই! দিনভর সহিংসতায় জনসাধারণের ভোগান্তির কথা বাদই দিলাম। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? সোহরাওয়ার্দী কলেজের সহিংসতার ঘটনা পুরো পুরান ঢাকাকে অচল করে দিয়েছিল। মানুষ এক বিভীষিকাময় বাস্তবতার মুখোমুখি। গতকাল প্রেসক্লাবের সামনে অবরোধ করেছিল ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকরা। গতকাল কাওরান বাজারে সামনে দুই গরু জবাই দিয়ে জিয়াফত উৎসব পালন করেছে ‘প্রথম আলো-ডেইলি স্টার’ বিরোধী কতিপয় মানুষ। সবকিছু মিলিয়ে এক অশনি সংকেত যেন পুরো দেশজুড়ে। কোথাও নিরাপত্তা নেই। ছিনতাই রাহাজানি এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। কয়েকজন মানুষ একত্রিত হয়ে লাঠি সোঠা নিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে। জনজীবনে নেমে আসছে অসহনীয় দুর্ভোগ। কোথাও বাঁধা দেয়ার কেউ নেই, কেউ কিছু বলার নেই। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কথা বলা হচ্ছে। নানা রকম আশ্বাস দেয়া হচ্ছে কিন্তু বাস্তবতা হল বাংলাদেশ যেন এক যুদ্ধ ক্ষেত্র। সবকিছু দেখে শুনে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ এখন আফগানিস্তান হতে কত দূরে কিংবা সিরিয়া? নাকি বাংলাদেশ এখন পাকিস্তান হওয়ার পথে? এই তিনটি রাষ্ট্রই ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ এর তকমা পেয়েছে। এই রাষ্ট্রগুলোতে আইন নেই, কানুন নেই। জোর যার মল্লুক তার। অনেকটা ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’র মত সমাজ চালু হয়েছে এই দেশগুলোতে। এখন বাংলাদেশও কি সেই পথে হাঁটছে? অথচ বাংলাদেশের এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। বাংলাদেশকে বলা হত ‘উদীয়মান বাঘ’। এশিয়ার সবচেয়ে দ্রুত উন্নতি লাভ করা দেশগুলোর তালিকায় ছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নতি সারা বিশ্বে চর্চার বিষয় পরিণত হয়েছিল।
এ কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, দুর্নীতি হয়েছে বেশুমার। দুর্নীতির সাথে কিছু মানুষের সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা ছিলো লাগামহীন। বাংলাদেশের যে পরিমাণ উন্নতি করার কথা ছিল, সেটি বাংলাদেশ করতে পারেনি দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং লুণ্ঠনের কারণে। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারাটা ছিল অত্যন্ত সজীব সতেজ। করোনার পরও বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর মত বড় ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পরেনি। বাংলাদেশে ২০২৪ জুলাই মাসে যে আন্দোলন হয়েছে তা মূলত কোটা সংস্কার আন্দোলন। সেই কোটা সংস্কার আন্দোলন পরবর্তীতে ৯ দফা আন্দোলনে পর্যবসিত হয়। ৫ আগস্ট টানা সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে অনেকেই আশা করেছিল যে, এটি বাংলাদেশের ‘নতুন স্বাধীনতা’। এই ‘নতুন স্বাধীনতা’ বাংলাদেশকে আরও বহু দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতা অর্গল মুক্তি হবে। বাংলাদেশের সব মানুষ সুখে শান্তিতে বসবাস করবে। ক্ষত গুলো সারিয়ে এদেশ একটি নতুন উন্নয়ন অগ্রযাত্রার মাইল ফলক স্পর্শ করবে। কিন্তু গত সাড়ে তিন মাসে শুধুই আশাহতের বেদনা। প্রথম দিকে ধারণা করা হয়েছিল যে, একটি সরকারের পতনের পর নতুন সরকার আসলে স্বাভাবিক ভাবে কিছু দাবি দাওয়া নিয়ে মানুষ জন সোচ্চার হয়, এটি স্বাভাবিক ব্যাপার। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছিল ১৬ বছরের জঞ্জাল পরিষ্কার করতে সময় লাগবে। আস্তে আস্তে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। সরকার পরিস্থিতি বিচক্ষণতার সাথে মোকাবিলা করতে পারবে। কিন্তু পুরো সমাজে দেখা যাচ্ছে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদেরকে মানছে না, শিক্ষকদের অপমানিত লাঞ্ছিত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে। প্রশাসনিক কোনো শৃংখলা নেই। ঘুষের বিনিময়ে ডিসি পদায়ন হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সেই অভিযোগের কূলকিনারা পাই নাই সাধারণ মানুষ। পুলিশ বাহিনী এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক নয়। ৫ আগস্ট ঘটনার পর পুলিশ বাহিনীই যেন এখন পর্যন্ত নিষ্ক্রিয়তার ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেনাবাহিনী দিয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার চেষ্টা চলছে। গত সাড়ে ৩ মাস ধরে মাঠে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর সম্পর্কে যে মানুষের ধারণা, শ্রদ্ধা, ভীতি এবং সম্মান ছিল সেটি আস্তে আস্তে কেটে যেতে শুরু করেছে। এখন বাস্তবতা যাই হোক না কেন সাধারণ মানুষ আশ্বস্ত নয়, বরং আতঙ্কিত। ৫ আগস্টের পর থেকে খুন ছিনতাই রাহাজানি ছিল একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বিএনপি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা দখলের উৎসবে মেতেছিল। যদিও বিএনপি পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, যারা দখল করবে তাদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। নদীর ঘাট থেকে শুরু করে বাড়ি-ঘর সবকিছুই যে যেভাবে পেরেছে দখল করেছে।
এ তো গেল দখলদারিত্বের খতিয়ান। বিভিন্ন স্থানে চুরি ছিনতাই রাহাজানি হয়ে গেছে এখন নিত্য নৈমিত্তিক স্বাভাবিক ব্যাপার। মানুষ রাতের বেলা নিজের বাসায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারবে কিনা তার গ্যারান্টি নেই। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের রিপোর্টে আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতি ভয়াবহতার চিত্র ফুটে উঠেছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু সরকারের এই বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুবই সামান্য। শুধু মাত্র আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতি অবনতি নয়, মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করেছে। ব্যবসা বাণিজ্য স্থবির। বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমে এসেছে এক ধরনের নিস্তব্ধতা। এ রকম একটি বাস্তবতায় সামনের দিনগুলোতে অর্থনীতি যে মুখ থুবড়ে পড়বে না তার গ্যারান্টি কে দেবে? সরকার মূলত নির্ভর করছে বিদেশি ঋণ এবং রেমিট্যান্সের উপর। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যদি ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প এবং দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তারা স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে না পারেন তাহলে রেমিট্যান্স এবং ঋণ দিয়ে অর্থনীতির চাকা কতদিন ঘুরবে সে প্রশ্ন থেকে যায়।
বতর্মান সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে তাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু কি তাই নির্ধারণ করতে পারেনি বলে এখন পর্যন্ত প্রতীয়মান হয়। একদিকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, বিভিন্ন রকম মামলায় হাজার হাজার আওয়ামী লীগ কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন, সেই সমস্ত মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়ারও কোনও খবর নেই এখন পর্যন্ত। অন্যদিকে সব অরাজকতা আওয়ামী লীগের সৃষ্ট এমন এক অদ্ভূদ ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ আবিষ্কারের চেষ্টা। যে আওয়ামী লীগের কোনও নেতাই দেশে নেই, তারা করবে ষড়যন্ত্র? আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বেঁচে থাকতেই হিমসিম খাচ্ছে। এমন উদ্ভট যুক্তি দিয়ে সমস্যা উপেক্ষা করা হচ্ছে।
সরকার বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এই সংস্কার কমিশনের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন মহল। এই সংস্কার প্রস্তাব গুলো কতটুকু বাস্তবায়ন যোগ্য, কতটুকু নির্বাচিত সরকার করবে?- সে নিয়েও রাজনীতির মাঠে নানা বিতর্ক চলছে। সংস্কার নিয়েও কোনো আশার আলো লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে বল প্রয়োগের নীতি সমাজের সর্বস্তরে দগদগে ঘায়ের মতো ফুটে উঠেছে। যে যেভাবে পাচ্ছে শক্তি প্রদর্শন করে তার দাবী আদায় করছে। আর এই শক্তি প্রদর্শনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ যেন অসহায়।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নানা দাবীতে ভাঙচুর করছে। কয়েক দিন আগে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা মহাখালি রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করল। গতকাল সোহাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা ভাঙচুর করেছে। ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের গোলোযোগের কারণে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। শিক্ষায় এক ঘোর অমানিশা অন্ধকার। বাংলাদেশের শিক্ষার ভবিষ্যত নিয়ে কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। কদিন আগেও মনে করা হতো বাংলাদেশ হয়তো সিঙ্গাপুর হবে। পাকিস্তানে টেলিভিশনের আলোচকরা বলেছিলেন যে, পাকিস্তানকে সিঙ্গাপুর বানানোর দরকার নেই, বাংলাদেশ বানালেই হবে। সেই বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা এখন পাকিস্তানের চেয়েও খারাপ। পাকিস্তানে যেমন জোর যার মুল্লুক তার, দখল এবং শক্তি প্রয়োগের এক সামাজিক ব্যাধি ঠিক সেই ব্যাধিতে যেন আক্রান্ত বাংলাদেশ। এখানে যে যেভাবে পারছে তার শক্তি প্রদর্শন করছে। দেশ যেন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির দিকে যাত্রা শুরু করেছে। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা দেখে কেউ কেউ মনে করেন যে, বাংলাদেশ বোধহয় সিরিয়ার মত হতে যাচ্ছে, যেখানে কোন আইন নেই। মানুষ অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে। বিচার নিজের হাতে তুলে নেয়-সেই রকম একটি পরিস্থিতির দিকেই কি যাচ্ছি আমরা? নাকি তার চেয়েও ভয়ঙ্কর, আফগানিস্তানের মত পরিস্থিতি বাংলাদেশে হচ্ছে? নাকি বাংলাদেশ আরেকটি পাকিস্তান হতে যাচ্ছে?
Comments
Ali
1 month agoসহমত
Afsana Kishwat
1 month agoপরিস্থিতি অবর্ণনীয়-ইউনুস গং কেন নিজেদের উদ্যোগে এমন করছে তা তারাই খোলাসা করে বলতে পারবে।
Leave a Comment