ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে সাংবাদিকতা
দায়িত্ব গ্রহণের এক মাস পর গত ১১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘সংবাদমাধ্যম ও মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ইতিমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। আপনার মন খুলে আমাদের সমালোচনা করেন।’ এরপর ঠিক প্রায় এক মাস পর গত ১২ অক্টোবর কক্সবাজার প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেসসচিব সুচিস্মিতা তিথি একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে মন খুলে সমালোচনা করা যাবে। সরকার মিডিয়াকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে না। কোন নিউজের কেমন ট্রিটমেন্ট হবে, তা নিয়ে চাপ দেবে না সরকার।’ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সংবাদকর্মীদের নির্ভয়ে কাজ করার ব্যাপারে এরকম আশ্বাস সরকারের পক্ষ থেকে পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় দেয়া হয়েছে, বলা হয়েছে। কিন্তু সরকার বা সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে কতটা আন্তরিক সেটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে সামনে এসেছে।
সম্প্রতি ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের সম্পাদক এবং সিনিয়র সাংবাদিক নূরুল কবীরকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। নূরুল কবীর এর ভেরিফাইড ফেসবুকে শেয়ার করা তার পোস্ট থেকে জানা গেছে ১৮ নভেম্বর তিনি একটি মিডিয়া সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়ার আগে ঢাকার বিমান বন্দরে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা কর্মকর্তাদের দ্বারা হয়রানির শিকার হন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে যখন তিনি দেশে ফেরেন তখনও। উল্লেখ্য যে, ৫ আগস্ট ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর থেকে সাংবাদিকদের একাংশকে আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর বা দালাল হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। দুই শতাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা মামলা দায়ের কথা হয়েছে। সম্প্রতি আবার ১৬৫ জনের বেশি সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে। ২৮ জন সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এরকম বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকদের একাংশকে প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। অভিযোগ করা হচ্ছে যে গণমাধ্যম আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করেছে। আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষমতায় রাখতে গণমাধ্যম সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। একই সঙ্গে অভিযোগ করা হচ্ছে যে, জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময় গণহত্যায় গণমাধ্যম উস্কানি দিয়েছে এবং এই অভিযোগে কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার অভিযোগ পর্যন্ত করা হয়েছে। এভাবে গণমাধ্যমকে এক ধরনের চাপের মুখে ফেলা হয়েছে। যার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হলো নূরুল কবীরকে বিমান বন্দরে হয়রানির ঘটনা। অথচ এই নূরুল কবীর গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের কট্টর সমালোচক ছিলেন। সরকারের বিরাগ ভাজন হতে হয়েছিল তাকে। যদি নূরুল কবীবের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছে অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রেস উইং। একই সঙ্গে এ ঘটনায় অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে আজ পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও এই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে একটি বিবৃতি কিংবা একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিই যথেষ্ট। সরকার যে নির্ভয়ের আশ্বাস দিয়েছে, সাহস নিয়ে কাজ করতে আহ্বান জানিয়েছে বস্তুত মাঠে সেটা দৃশ্যমান নয়।
শুধু নূরুল কবীর নয়, গত ১৫ বছরে সরকারের কঠোর সমালোচনা করে করেছিল দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার পত্রিকাও। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন গণমাধ্যমকে নির্ভয়ে কাজ করার আশ্বাস দিচ্ছে ঠিক তখন প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকা অফিসের সামনে বিক্ষোভ হচ্ছে। গত শুক্রবার ‘বাংলাদেশের জনগণ’ ব্যানারে ডেইলি স্টার অফিসের সামনে বিক্ষোভ হয়। এ সময় তারা এই গণমাধ্যমটিকে ভারতীয় আগ্রাসনে সহায়তাকারী হিসেবে চিহ্নিত করে। এর আগে একই চিত্র দেখা গেছে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনেও। ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোকে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ‘জঙ্গি বানানোর কারিগর’ হিসেবেও অ্যাখ্যায়িত করে বিক্ষোভকারী জনতা। গণমাধ্যম অফিসের সামনে এমন চিত্র গণমাধ্যমে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি বা আতঙ্ক তৈরি করেছে। অথচ প্রথম আলো, ডেইলি স্টার আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সময় বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেছে। অথচ তারাই এখন আক্রোশের শিকার। তাদের অফিসের সামনে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার এ ধরনের ঘটনাকে নিরুৎসাহিত করা, বরদাস্ত করা হবে না বলে আশ্বস্ত করা হলেও পরিস্থিতির কোন উন্নতি হচ্ছে না। বরং গণমাধ্যমের উপর অঘোষিত এক বিধি-নিষেধ, অদৃশ্য আতঙ্ক কাজ করছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলাগুলো এখনো নিষ্পত্তি করা হয়নি বা বাতিল করা হয়নি। বরং এখনো গণমাধ্যমকে, গণমাধ্যমের একাংশ সাংবাদিকদের আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর বা দালাল হিসেবে বলা চিহ্নিত করা হচ্ছে।
বস্তুত যে কোনও পেশাজীবী মানুষের তার নিজস্ব একটি আলাদা মতবাদ, দর্শন কিংবা তিনি যে কোনও একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক হতে পারে। এটি তার ব্যক্তি স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার। কিন্তু তাই বলে তাকে কোনও পক্ষের লোক বলে অভিহিত করা কতটা যুক্তি সঙ্গত সেটি একটি প্রশ্ন। অন্তর্বর্তী সরকারও সম্প্রতি দেশের একাধিক সিনিয়র প্রথিতযশা সাংবাদিককে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর পদে নিয়োগ দিয়েছেন। তাই বলে কি তারা এই সরকারের দোসর বা সরকারের দালাল? অবশ্যই সেটি নয়। তাদের এই কর্মে নিয়োগ করা হয়েছে তাদের কর্মদক্ষতা এবং যোগ্যতার জন্য। ওই ব্যক্তি উক্ত পদের জন্য যোগ্য মর্মে তাকে সংশ্লিষ্ট পদে নিয়োগ করা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের শাসনামলে যারা এ সমস্ত পদে দায়িত্ব পালন করেছে তাদেরকে দোসর বা দালাল হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। তাদের ভাষায় এই পদগুলো যদি দালালী করার জন্যই হয় তাহলে কি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব হস্তান্তর করলে এখন যারা এসমস্ত পদে নিয়োগ পাচ্ছেন তারাও দালাল হিসেবে অভিহিত হবেন- সেটি একটি বড় প্রশ্ন। যদি সেটি করা হয় তবে কখনোই তা যুক্তিসঙ্গত নয় এবং সেটি করা অনুচিত হবে। কেউ যদি অবৈধ কোনও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকে, কারও নামে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থেকে থাকে তাহলে সেটি তদন্ত সাপেক্ষে বিচার হতে পারে। কিন্তু ঢালাও ভাবে কাউকে অভিযুক্ত করা, হয়রানি করা কাম্য নয়। দিনশেষে এতে করে সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি বাড়বে, অস্থিরতা বাড়বে, দেশ পিছিয়ে পড়বে। যা আমরা কেউই প্রত্যাশা করিনা। কাজেই একজন সাংবাদিক বা সাধারণ মানুষ কিংবা অন্য যে কোনও পেশারই হোক না কেন বিরোধী মতপ্রকাশের জন্য কাউকে হয়রানি করার সংস্কৃতি একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের চর্চা হতে পারে না।
Comments
Leave a Comment