Post Thumbnail

বিপর্যস্ত বিশৃঙ্খল গণমাধ্যম


৫ আগস্টের পর সবচেয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান গুলো তার মধ্যে গণমাধ্যম একটি। গণমাধ্যম শুধু বিপর্যস্ত এবং বিশৃঙ্খল অবস্থাতেই নেই, রীতিমতো দখল এবং আতঙ্কের রাজত্ব চলছে গোটা গণমাধ্যম জুড়ে। একের পর এক বিভিন্ন ‘মিডিয়া হাউস’ দখল হচ্ছে। কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে প্রতিদিন। শীর্ষ পদগুলোতে হচ্ছে ইচ্ছেমতো রদবদল। আওয়ামীপন্থি হিসেবে যাঁরা পরিচিত তাঁদেরকে ঝেঁটিয়ে বিদায় দেয়া হচ্ছে। মূলত বিএনপি-জামায়াতপন্থি সাংবাদিক, যারা এতো দিন আধা বেকার বা বেকার ছিলেন, তাঁরাই বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলো দখল করছেন। পত্রিকার মালিকরাও অসহায়। নিজেদের বাঁচাতে কেউ ঝামেলায় জড়াতে চাইছেন না। যদিও তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম দাবি করেছেন, ৫৩ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে স্বাধীনতা উপভোগ করছে গণমাধ্যম। বাস্তবে স্বাধীনতার নামে চলছে এক ধরনের আতঙ্ক এবং ভয়ের সংস্কৃতি। 

৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত দুইশ জনের বেশি গণমাধ্যমকর্মীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, এই সমস্ত মামলাগুলো ভিত্তিহীন। এসব মামলা তদন্তের পর্যায়েই শেষ হয়ে যাবে বলে আশ্বস্ত করা হচ্ছে। কিন্তু এটি সাংবাদিকদের আতঙ্ক কমাতে পারেনি। বিশেষ করে বিভিন্ন সাংবাদিকদের গ্রেফতারের ঘটনার পরে আতঙ্ক বেড়ে গেছে। নানারকম গুজব ছড়ানো হচ্ছে। কোন সাংবাদিককে কবে গ্রেফতার করা হবে এ ধরনের তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উড়ে বেড়াচ্ছে। কোন কোন মহল থেকে হুমকিও দেয়া হচ্ছে। ফলে গণমাধ্যম কর্মীরা স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে পারছে না। এ পর্যন্ত ১৬৫ জনের বেশি সংবাদকর্মীর প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে। এটি নিয়ে আরেকটি ভীতির রাজত্ব তৈরি হয়েছে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে এ ধরনের ঘটনায় উদ্বেগ জানানো হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য এ ব্যাপারে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। বরং বলা হয়েছে, যদি কারও অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড অযৌক্তিক কারণে বাতিল হয়ে থাকে সেটি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এ রকম আশ্বাসে গণমাধ্যম কর্মীরা আশ্বস্ত হচ্ছেন না। ২৮ জন গণমাধ্যম কর্মীর বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ)। সেই তদন্তের অগ্রগতি কী এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। 

এ তো গেল গণমাধ্যমের ওপর নিগ্রহের ঘটনা। কিন্তু বিভিন্ন ‘মিডিয়া হাউস’ গুলোতে চলছে তুলকালাম অস্থিরতা। মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো রদবদল ঘটছে গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ পদগুলোতে। অনেকে চাকরি হারাচ্ছেন। ৫ আগস্টের পর বেশ কিছু মিডিয়া হাউসে ভাঙচুর অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। যেসব কোনটিরই তদন্ত হয়নি, বিচার তো দূরের কথা। তারপর মিডিয়া গুলো যখন পুনঃসংগঠিত হয়ে আবার নতুন করে আত্মপ্রকাশ শুরু করে, তখনই শুরু হয় ভেতর থেকে শুদ্ধিকরণ অভিযান। ইতিমধ্যে ‘সময়’ টেলিভিশনে পট পরিবর্তন হয়েছে। সেখানে চাকরিচ্যুত হয়েছেন আওয়ামী লীগ হিসাবে পরিচিত বহু সাংবাদিক। ডিবিসিতে টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করছে। ডিবিসি’র সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঞ্জুরুল ইসলাম দেশে নেই। অন্যদিকে বিভিন্ন পদে ঘন ঘন রদবদল হচ্ছে। ইতিমধ্যে সেখান থেকে একাধিক সংবাদকর্মীর চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। একাত্তর টেলিভিশনের সিইও মোজাম্মেল বাবু ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। সিইও হিসেবে দেয়া হয়েছে বিএনপিপন্থি সাংবাদিককে। তবে এই চ্যানেলের পরিস্থিতি এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। সর্বশেষ আক্রান্ত হয়েছে বৈশাখী টেলিভিশন। সেখান থেকে শীর্ষ পদে দু জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এই টেলিভিশন চ্যানেলটি নতুন ভাবে দখলের সব আয়োজন সম্পন্ন। অন্যান্য টেলিভিশন চ্যানেলে রয়েছে চাপা অস্থিরতা। আওয়ামী সমর্থক বা আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল এমন সাংবাদিকদের চাকরী করাটাই এখন দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। এটি নিয়ে কোনও প্রতিবাদ করারও কেউ নেই। ইতিমধ্যে জাতীয় প্রেস ক্লাবে শুরু হয়েছে এক নতুন পরিস্থিতি। সেখানে ৩৭ জন সদস্যের সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে। তারা সবাই আওয়ামীপন্থি হিসেবে বিবেচিত। প্রেসক্লাবের নির্বাচনের জন্য কথা বলেছিলেন বিএনপিপন্থি কয়েকজন। কিন্তু তাদেরকে তীব্র বাঁধার মুখে পড়তে হয়। মূলত জামায়াত এবং বিএনপির কট্টরপন্থি অংশের নিয়ন্ত্রণে এখন প্রেস ক্লাব। 

প্রিন্ট মিডিয়ার হাউসগুলোতেও একই অস্থিরতার চিত্র। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালের কণ্ঠের সম্পাদক পদের পরিবর্তন হয়েছে। আরও বেশ কিছু পত্রিকার সম্পাদক পদে পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কখন কার চাকরি যাবে সেটি যেন একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে সবার সামনে এসেছে। সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রেও এক ধরনের ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ’ আরোপ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোনও সংবাদ পরিবেশনের আগে পত্রিকা এবং টেলিভিশন গুলো দশবার চিন্তা করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা এই ধরনের সংবাদ প্রকাশের কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে মিডিয়াকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময় মিডিয়াগুলো যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি। তাঁরা গণভবন থেকে প্রেসক্রিপশনে, ডিজিএফআই নির্দেশিত খবর পরিবেশন করেছে। এটি যে গণমাধ্যম বাধ্য হয়ে করেছে; তাতে বোঝাই যায়। তাহলে গণমাধ্যমের দোষ কোথায়?- সেই প্রশ্নটি করার সাহস কেউ দেখাতে পারছে না। 

গণমাধ্যমে শুধু অভ্যন্তরীণ এই সংকট এবং সীমাবদ্ধ তা নয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী মিডিয়া হাউস হিসেবে পরিচিত প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারেও এখন এক ভীতির রাজত্ব তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলোকে বয়কটের ডাক দেয়া হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কয়েকজন অ্যাক্টিভিস্ট এই দুটি পত্রিকাকে ‘ভারতের এজেন্ট’ হিসাবে অভিহিত করে এই দুটি পত্রিকা বর্জনের জন্য ডাক দিয়েছেন। পত্রিকা অফিস আক্রমণেরও উস্কানি চলছে। পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, কালবেলা ও সমকালের মতো পত্রিকাগুলোতে। বাংলাদেশে উগ্র দক্ষিণপন্থি গোষ্ঠী এই পত্রিকাগুলোকে টার্গেট করেছে। প্রথম আলো তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করেছে অনেকটা আটো সাটো ভাবে। চিরাচরিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র বা প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁয়ে না করে তাঁরা নিরাপদ রেডিসন ব্লু-তে গিয়ে তাঁদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর মূল পর্ব করেছে। যদিও প্রথম আলো, ডেইলি স্টার বর্তমান সরকারের সমর্থন এবং সহযোগিতা পাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা প্রথমে প্রথম আলোতে, পরবর্তীতে ডেইলি স্টারে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, কিন্তু একটি কট্টর গ্রুপ প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারকে হুমকি দিয়েই চলেছে। এর ফলে এই পত্রিকা দুটি সংযত।

সংবাদপত্রের বাঁধা দু রকম ভাবে আসে। একটি সরাসরি বাঁধা, যেটা অতীতে বিভিন্ন সরকার দিতো। এই সংবাদটি পরিবেশন করা যাবে, সংবাদ পরিবেশন করা যাবে না। এই সংবাদটির এই ভাবে হেডলাইন দিতে হবে। এই সংবাদটিকে এই ভাবে কম গুরুত্ব দিতে হবে ইত্যাদি। আর দ্বিতীয় হলো এমন একটি পরিবেশ বা আতঙ্কের পরিস্থিতি তৈরি করা হয়, যেখানে মিডিয়া স্বাধীনভাবে কথা বলার জন্য প্রস্তুত থাকে না। তাঁরা আতঙ্কে থাকে। একটা ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করে। এখন গণমাধ্যমে সেই অবস্থাই বিরাজ করছে। গণমাধ্যমে এই অস্থিরতার মধ্যেই গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনে যাদেরকে রাখা হয়েছে তাঁরা মূলধারা গণমাধ্যমে সঙ্গে কতটুকু সম্পৃক্ত এবং মূলধারার গণমাধ্যমের সমস্যা এবং সংকটের বিষয়গুলো সম্পর্কে কতটুকু অবহিত সেই প্রশ্নও উঠেছে। সবকিছু মিলিয়ে এখন গণমাধ্যমের জন্য চলছে এক ‘সংকটকাল’।


Comments

Leave a Comment


Related Articles