একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা; ইতিহাস যা সাক্ষী দেয়
সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি দাবি করেন, জামায়াতে ইসলামী এক পাকিস্তান চাইলেও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল না। কিন্তু ইতিহাস বলে জামায়াতে ইসলামী আমিরের এই বক্তব্য সঠিক নয়। আসুন দেখে নিই রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ এর লেখা ‘জামায়াতে ইসলামী উত্থান বিপর্যয় পুনরুত্থান’ গ্রন্থটি কি সাক্ষ্য বহন করে। আজ থাকছে চতুর্থ পর্ব।
আলবদর বাহিনীর আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে হিজরি দ্বিতীয় বর্ষের ১৭ রমজান (৬২৪ খ্রিষ্টাদ্বের ১৭ মার্চ) মদিনার ৮০ মাইল দূরে বদর উপত্যকার যুদ্ধের কথা প্রচার করেছিল জামায়াতে ইসলামী। মদিনার মুলসমানদের সঙ্গে মক্কার পৌত্তলিক কুরাইশদের এই যুদ্ধে মুসলমানদের জয় হয়। একাত্তরের যুদ্ধকে জামায়াত ‘মুসলমান রাষ্ট্র’ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘অনুপ্রবেশকারী ইসলামবিরোধী’শক্তির ষড়যন্ত্র ও হামলা হিসেবে প্রচার করে।
১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর জামায়তে ইসলামী বদর দিবস পালন করে। দিনটি ছিল ২৫ রমজান। ওইদিন ঢাকায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা মিছিল বের করে। জামায়াতের মুখপত্র সংগ্রাম পত্রিকায় এই বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। শিরোনাম ছিল-বদর দিবস: পাকিস্তান ও আলবদর। নিবন্ধে নিজামী লেখেন: বিগত দুবছর থেকে পাকিস্তানের একটি তরুণ কাফেলার ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের ছাত্র প্রতিষ্ঠান পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘ এই ঐতিহাসিক বদর দিবস পালনের সূচনা করেছে। সারা পাকিস্তানে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে এই দিবস উদযাপিত হওয়ার পেছনে এই তরুণ কাফেলার আবদান সবচেয়ে বেশি। হিন্দুবাহিনীর সংখ্যা-শক্তি আমাদের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি। তাছাড়া আধুনিক সমরাস্ত্রেও তারা পাকিস্তানের চেয়ে অধিক সুসজ্জিত। দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তানের কিছু মুনাফিক তাদের পক্ষ অবলম্বন করে ভেতর থেকে আমাদের দুর্বল করার ষড়যন্ত্র লিপ্ত হয়েছে। তাদের মোকাবিলা করেই তাদের সকল ষড়যন্ত্র বানচাল করে পাকিস্তানের আদর্শ ও অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে; শুধু পাকিস্তান রক্ষার আত্মরক্ষামূলক প্রচেষ্টা চালিয়েই এ পাকিস্তানকে রক্ষা করা যাবে না।
বদরের যুদ্ধ থেকে অনেক কিছুই আমাদের শিখবার আছে। এই যুদ্ধের সৈনিকরা কেউ পেশাদার বা বেতনভুক্ত সৈনিক ছিলেন না। মুসলমানরা সবাই ছিলেন সৈনিক, তারা সবাই ছিলেন স্বত:স্ফূর্ত প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ, ইমানের তাগিদেই তারা লড়তে প্রস্তুত হয়েছিলেন বিরাট শক্তির মোকাবিলায়। বৈষয়িক কোনো স্বার্থ ছিল না তাদের সামনে। ‘মরলে শহিদ, বাঁচলে গাজি’-এই ছিল তাদের বিশ্বাসের অঙ্গ। ইমানের পরীক্ষায় তারা ছিলেন উত্তীর্ণ। সংখ্যার চেয়ে গুণের প্রাধান্য ছিল সেখানে লক্ষণীয়। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহের লেশমাত্র ছিল না তাদের মাঝে। একমাত্র আল্লাহর সাহায্য ছিল তাদের সম্বল। আর আল্লাহ সন্তোষ ছিল তাদের কাম্য। আজকের কাফেরদের পর্যুদস্ত করতে হলে আমাদের মধ্যেও অনুরূপ গুণাবালির সমাবেশ অবশ্যই ঘটাতে হবে।
আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে। পাকিস্তানি সেনার সহযোগিতায় এদেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্রসমাজ বদরযুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। বদরযুদ্ধে মুসলিম যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল তিনশত তেরো। এই স্মৃতিকে অবলম্বন করে তারাও তিনশত তেরোজন যুবকের সমন্বয়ে এক একটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বদর যোদ্ধাদের যেসব গুণাবলির কথা আমরা আলোচনা করেছি, আলবদরের তরুণ মর্দে মুজাহিদদের মধ্যে ইনশাআল্লাহ সেসব গুণাবালি আমরা দেখতে পাব।
পাকিস্তানের আদর্শ ও অস্তিত্ব রক্ষার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে গঠিত আলবদরের যুবকেরা এবারের ‘বদর দিবস’-এ নতুন করে শপথ নিয়েছে, তাদের তেজোদীপ্ত কর্মীদের তৎপরতা ফলেই ‘বদর দিবস’ কর্মসূচি দেশবাসী তথা দুনিয়ার মুসলমানদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। ইনশাআল্লাহ বদরযুদ্ধের বাস্তব স্মতিও তারা তুলে ধরতে সক্ষম হবে। আমাদের বিশ্বাস, সেদিন আর খুব দূরে নয়, যেদিন আলবদরের তরুণ যুবকেরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দুবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হিন্দুস্থানকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করবে।
৭
একাত্তরের ৭ আগস্ট ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত ৭৮ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করে। ২ সেপ্টেম্বর সরকারের এক ঘোষণায় ১২ ডিসেম্বর থেকে শূন্য আসনগুলোতে উপনির্বাচনের কথা বলা হয়। সমমনা দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী উপনির্বাচনে অংশ নেয়। ৯ নভেম্বর পর্যন্ত যে ৫৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হন, তাঁদের মধ্যে জামায়াতের সদস্য ছিলেন ১৫ জন। দলীয় ভিত্তিতে এই সংখ্যাই ছিল সর্বোচ্চ। এই উপনির্বাচনে গোলাম আযম টাঙ্গাইলের একটি আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হন। জামায়াতের সদস্যদের মধ্যে ‘নির্বাচিত’ অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন বরিশালের মাওলানা আবদুর রহিম, বগুড়ার সাদ আহমদ ও আবদুল মতিন, ঢাকার অধ্যাপক ইউসুফ আলী, রংপুরের জবান উদ্দীন আহমেদ, দিনাজপুরের মাওলানা তমিজুদ্দিন ও আবদুল্লাহ আল কাফি, ময়মনসিংহের এস এস ইউসুফ, নোয়াখালীর সফিউল্লা, রাজশাহীর আফাজ উদ্দিন আহমদ, পাবনার মাওলানা আবদুস সোবহান এবং টাঙ্গাইলের অধ্যাপক আব্দুল খালেক।
উপনির্বাচনে জামায়াতসহ ডানপন্থীদের মোট জাতীয় পরিষদ সদস্য হয় ৯০ জন। আরও ২০টি আসনে তাদের জয় নিশ্চিত ছিল। ইয়াহিয়া ২৭ ডিসেম্বর থেকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরুর ঘোষণা দিলে পাকিস্তানপন্থীরা ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। গোলাম আযম ১৫ নভেম্বর দাবি জানান, প্রধানমন্ত্রীর পদটি যেন একজন পূর্ব পাকিস্তানিকে দেওয়া হয়। ১ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে অর্থ ও পররাষ্ট্র দপ্তরও পূর্ব পাকিস্তানিদের হাতে দেওয়ার দাবি জানিয়ে পশ্চিমী ভাইদের উদ্দেশ্য বলেন, ‘দেশের এই অংশের জনগণের মন থেকে অতীতের বঞ্চনার মনোভাব দূর করতে হলে প্রধান রাজনৈতিক পদটি অবশ্যই একজন পূর্ব পাকিস্তানিকে দিতে হবে।’
চলবে (আগামীকাল থাকছে পঞ্চম পর্ব)
Comments
boyarka-inform.Com
3 weeks agoThhis paragraph is genuinely a good one it helps new web viewers, who are wishiung for blogging. http://boyarka-inform.com
Leave a Comment