কথায় কথায় জিম্মি জন সাধারণ
বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নামবিও’র প্রকাশিত এক তথ্যমতে, বিশ্বের শীর্ষ যানজট শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। যেখানে গাড়ির গতি কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে। অথচ ২০০৭ সালে এটি ছিল ২১ কিলোমিটার। ঘনবসতির কারণে ঢাকার এই করুণ অবস্থা। এছাড়াও শৃঙ্খলা না মেনে গাড়ি চালানো, রাজধানীর বিভিন্ন ব্যস্ত সড়কে মেগা প্রকল্পগুলোর কালক্ষেপণ, ব্যক্তিগত গাড়িনির্ভর পরিকল্পনা, দুর্বল ট্রাফিক সিগন্যাল ও মনিটরিং ব্যবস্থা, যানবাহন নিবন্ধনে অব্যবস্থাপনা, সার্বিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞানভিত্তিক ও আধুনিক পদ্ধতির অভাবসহ বেশ কিছু কারণ দায়ী। এর উপর সাম্প্রতিক সময় যেভাবে দাবী আদায়ের আন্দোলন পুরো ঢাকা জুড়ে শুরু হয়েছে তা রীতিমতো জন সাধারণকে জিম্ম করার নামান্তর। গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে এসে মহাখালী রেলক্রসিং এলাকায় সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন। বিকেল ৪টা পর্যন্ত এই অবরোধ চলে। কিছু সময়ের জন্য উঠে গিয়ে তারা ফের কলেজের সামনের সড়কে বসে পড়ে। এতে করে পুরো এলাকা জুড়ে তীব্র যানজট তৈরি হয়। অফিস শেষে ঘর ফেরত হাজার হাজার সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পরে। আজ কলেজ ক্লোজডাউন ঘোষণা করে অবরোধ কর্মসূচি করে। আগামীকাল মহাখালীতে ‘বারাসাত ব্যারিকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে আজ মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘ওভার নাইট কোনো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় করা সম্ভব না। এটি অযৌক্তিক।’
সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দিকে গেছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধিদল। বিকেলে ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দিকে যায়। তারা হলেন মাহমুদ হাসান মুক্তার, মোশাররফ রাব্বি, নেয়েক নূর মোহাম্মদ, আবদুল হামিদ, নূরুদ্দিন জিসান, মতিউর রহমান জয়, জাহাঙ্গীর সানি, মেহেদী হাসান মাল, আমিনুল ইসলাম, মোহাম্মদ বেল্লাল, আল নোমান নিরব, হাবিবুল্লাহ রনি, তোয়াহা ও কাউসার।
শুধু তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনই নয়, ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক আন্দোলনের কথা শোনা গেছে। যে কোন দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে আন্দোলনকারীরা বারবার সড়ক অবরোধ করছে। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করছে। গতকাল তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের একপর্যায়ে তারা মহাখালী রেল ক্রসিং অবরোধ করে এবং দুটি আন্তঃনগর ট্রেন থামিয়ে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে শিশুসহ দুই ট্রেনের ভেতরে থাকা বেশ কয়েকজন যাত্রী গুরুতর আহতের ঘটনা ঘটেছে। এভাবে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে, জনমালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে টেলে দিয়ে দাবী আদায়ের কৌশল কতটা যৌক্তিক সেটি একটি কোটি টাকার প্রশ্ন। মানুষজনকে আজকাল ঘর থেকে বের হতে দশবার চিন্তা করতে হচ্ছে! কেউ বের হলে তিনি এক অজানা আশঙ্কা সঙ্গে নিয়ে বেরোচ্ছেন! রাস্তায় চলতে চলতে কোথায় তাকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বসে থাকতে হয় তা কেউ জানে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দাবী আদায়ের উপায় হিসেবে সড়ক অবরোধ করা এখন আমাদের সংস্কৃতিতে এক প্রকার অনুপ্রবেশ করেছে। আমাদের বিভিন্ন রকম দাবিদাওয়া থাকতেই পারে। কিন্তু আমরা যে কৌশল অবলম্বন করছি, তা জন সাধারণের ভোগান্তির কারণ হচ্ছে। তারা বলছেন, সড়ক অবরোধের বিষয়টি আগেও ছিলো কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের পর এটি যেন সীমা লঙ্ঘন করেছে। অবশ্য এর একটি কারণও আছে বটে। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, এভাবে অবরোধ করলে দাবী আদায় করা সম্ভব। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো এইচএসসি পরীক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত। মূলত সেখান থেকেই আন্দোলনকারীরা অনুপ্রেরণা পেয়েছে। পরবর্তীতে আমরা দেখলাম দাবী আদায়ের জন্য সবাই যেন এখন সচিবালয়মুখী। তাদের মধ্যে এই ধারণা জন্ম নিয়েছে যে, সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি করলে, সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি করলে দাবী আদায় করা সহজ হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো দাবী আদায় হোক বা না হোক এরকম ঘটনার মধ্য দিয়ে জন সাধারণ জিম্মি করা হচ্ছে এবং এতে করে বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। প্রভাব পড়ছে আমাদের অর্থনীতির উপরও।
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর এক তথ্যমতে, ঢাকায় যানজটের কারণে নষ্ট হচ্ছে দৈনিক প্রায় ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা। অর্থমূল্যে যা দৈনিক প্রায় ১৩৯ কোটি এবং বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার অধিক। এভাবে কথায় কথায় দাবী আদায়ে অবরোধ কর্মসূচি পালন করলে এই ক্ষতির পরিমাণ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলাই বাহুল্য। সুতরাং দাবী আদায়ের উপায় বা কৌশল হিসেবে আমাদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে।
Comments
Leave a Comment