আওয়ামী লীগের কোটিপতি নেতা বনাম নিঃস্ব কর্মী
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগের একজন সাবেক এমপির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তিনি বিদেশে বসে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে রীতিমতো উৎসব করছেন, তালি বাজিয়ে গান গাচ্ছেন। বোঝাই যাচ্ছে রঙীন পানীয় পেটে পরার পরই এই বেপরোয়া উচ্ছ্বাস। তিনি যখন এরকম মজমা বসিয়েছেন, ঠিক সেই সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে আওয়ামী লীগের কর্মীদের নাজেহাল দশা। আওয়ামী লীগের একজন কর্মী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছেন যে তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। স্ত্রীর ডেলিভারির জন্য চিকিৎসার টাকাটাও তার নেই। তিনি নিজেই ফেরারী। দূর দেশ থেকে একজন আওয়ামী লীগের একজন সমর্থক তার জন্য কিছু টাকা পাঠিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে আরও টাকা লাগলে তাকে দেয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের বহু কর্মী হাসপাতালে আহত অবস্থায় কাতরাচ্ছেন। তাদের চিকিৎসা করার জন্য ন্যূনতম টাকা নেই। অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের জামিনের জন্য আদালতে আইনি প্রক্রিয়া করার মতো অর্থ নেই। অনেক আওয়ামী লীগের কর্মী ঘরছাড়া, তাঁরা দু বেলা দু মুঠো খেতে পারছেন না। তাদের পরিবার পথে বসেছে। সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ। কারো কারো বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কিন্তু তাঁদের খবর কে রাখে? কেউ পাশে নেই তাদের।
গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের যে সমস্ত নেতারা বিপুল পরিমাণ অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছেন, তারা তাদের অর্থবিত্ত নিয়ে এখন বিদেশে আরাম আয়েশের জীবনযাপন করছেন। তারা সেখানে বসে রীতিমতো আমোদ ফুর্তিতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। তারা কর্মীদের খবর রাখবেন কীভাবে? কর্মীদের খবর রাখার সময় কই তাদের। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর অধিকাংশ নেতা বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই ভারতে অবস্থান করছেন। কেউ কেউ দুবাই, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায়। সেখানে তাদের রয়েছে বিপুল সম্পদ। যা দিয়ে তার যত পুরুষ রাজার হালে থাকতে পারবেন। যারা ৫ আগস্টের পর যেতে পারেননি, তারাও অনেকে পরে ভারতে গেছেন। এদের সবার ঝামেলাহীন জীবন।
একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ভারতে পালিয়ে গেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কীভাবে তিনি ভারতে পালিয়ে গেলেন সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু হাজার কোটি টাকার মালিক ওবায়দুল কাদের দলের কোন নেতা-কর্মীদের কোন খবর নিচ্ছেন না। অথচ তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক। এই কঠিন পরিস্থিতিতে দলের নেতা-কর্মীদের জন্য সাহায্য করাটা তার প্রধান দায়িত্বের একটি। ওবায়দুল কাদের যেমন কোন খোঁজখবর নিচ্ছেন না, তেমনি আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতারা, যাঁরা গলা কাঁপিয়ে বিভিন্ন সময়ে কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতেন, কর্মীদেরকে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য হুঙ্কার দিতেন, তারা সপরিবারে বিদেশে রীতিমত সংসার পেতেছেন। দামি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে তারা কাজের লোককে পর্যন্ত সেখানে নিয়ে গেছেন। এই সমস্ত নেতারা মাঝে মাঝে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবির্ভূত হয়ে গলা বাজী করেন। কিন্তু কর্মীদের জন্য দু টাকা খরচ করার মতো মানসিকতা তাদের নেই। কর্মীদের বিপদে ন্যূনতম মহানুভব নেই তাদের। আওয়ামী লীগের এই সব নেতারাই আওয়ামী লীগের আজকের পরিণতির জন্য দায়ী। এরা ১৫ বছর রীতিমতো লুণ্ঠন করেছে, কমিটি বাণিজ্য করে দলকে ধ্বংস করেছে। আওয়ামী লীগের এই সমস্ত নেতারা সবাই বিদেশে। সবাই তাদের নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। কর্মীদেরকে শুধু তারা আগুনে ঝাঁপ দিতেই বলছেন। কিন্তু কর্মীদের জন্য সামান্য অনুশোচনা জানানো বা আর্থিক সাহায্য করার মানসিকতাটুকু পর্যন্ত তাদের নেই।
আওয়ামী লীগের সময় বেশ কিছু হাইব্রিড নেতার উদ্ভব ঘটেছিল। যে সমস্ত হাইব্রিড নেতারা আওয়ামী লীগ সভাপতির চারপাশ ঘিরে ছিল। আওয়ামী লীগের এই দুরবস্থার জন্য যাদেরকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়। এই সমস্ত হঠাৎ গজিয়ে উঠা নেতারা বিদেশে বসে ফেসবুকে নানা রকম কর্মসূচি ঘোষণা করছেন। বিভিন্ন নির্যাতনের খবর প্রকাশ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এই সমস্ত কর্মীদের পাশে কেউ দাঁড়াচ্ছে না, কর্মীদের সহযোগিতা করার মতো মানসিকতাও কারো নেই। ছাত্রলীগের সভাপতি এখন ভারতে পালিয়ে গেছেন। কিন্তু ছাত্রলীগের যে সমস্ত কর্মীরা এখন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি তাদের খবর কেউ নিচ্ছে না। আওয়ামী লীগের আরেক অঙ্গ সংগঠন যুব লীগের অবস্থা আরও খারাপ। যুবলীগের চেয়ারম্যান বিদেশে পলাতক। কর্মীরা এখানে কেউ না খেয়ে মারা যাচ্ছে, কেউ বিএনপি-জামায়াতের হাতে পিটুনি খেয়ে মারা যাচ্ছে। তাদের খবর নেয়ার মতো কেউ নেই। ক্ষমতাচ্যুতির সাড়ে তিন মাস হয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশ করতে পারেনি। কর্মীরা বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করছে বটে। তবে নেতৃত্বহীন এই সমস্ত উদ্যোগ কোনো ফল দিবে না। বরং এর ফলে তাদের উপরেও নেমে আসছে স্টিমরোলার। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা, ক্ষোভ, তীব্র দানা বেঁধে উঠেছে। আওয়ামী লীগকে রীতিমত ধ্বংস করা হয়েছে ৫ আগস্টের আগেই। এখন ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে কিছু কর্মী শুধু আর্তনাদ করছেন।
আওয়ামী লীগ কখনো এরকম বাজে পরিস্থিতির মধ্যে পড়েনি। এই পরিস্থিতির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা যেতে পারে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী, লোভী, দুর্নীতিবাজ নেতাদেরকে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ নেতাই দুর্নীতিগ্রস্ত। গত ১৫ বছর তারা আকণ্ঠ লুটপাটে নিমজ্জিত হয়েছিলেন। কর্মীদের কথা চিন্তা করেননি। সংগঠনের কথা চিন্তা করেনি। এখন তারা সংগঠনের জন্য একটি টাকা খরচ করার মতো প্রয়োজন অনুভব করছেন না। যে যেভাবে পেরেছেন লুট করেছেন, সেই লুটের টাকা যেন ১৪ পুরুষ নির্বিঘ্নে খেতে পারেন, তার বন্দোবস্ত করাটাই এখন এই সমস্ত নেতাদের প্রধান কাজ। অথচ বিএনপির ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল। এই ১৭ বছরে বিএনপির নেতারা নিগৃহীত হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন কিন্তু তারা কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কর্মীদের বাড়িতে গিয়েছিল, কর্মীদের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা করেছেন। তাদেরকে আইনি সহায়তা দিয়েছেন। বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল গত ১৭ বছর টিকে ছিল নেতাদের এই অভিভাবক সুলভ আচরণের কারণে। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারা শুধুমাত্র নিজেদের আখের গোছানোর কাজে ব্যস্ত। আওয়ামী লীগের ভেতরেই এখন লড়াই চলছে। আওয়ামী লীগ বাইরের প্রতিপক্ষের সঙ্গে কি লড়াই করবে? আওয়ামী লীগের লড়াই এখন হচ্ছে এখন নিজেদের মধ্যে। একদিকে কোটিপতি সুবিধাবাদী নেতা অন্যদিকে অসহায়, নির্যাতিত অর্থ সম্বলহীন নিঃস্ব কর্মী। এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কি কর্মীরা বাঁচতে পারবে? আওয়ামী লীগকে যদি ঘুরে দাঁড়াতে হয় তাহলে পরে তাদের নতুন করে সংগঠনকে পুনর্গঠন করতে হবে। দুর্নীতিবাজ, লোভী এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে দলের ভেতর যারা সৎ কর্মী বান্ধব এবং এরকম দুসময়ে দাঁড়াতে সক্ষম এরকম ব্যক্তিদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিতে হবে। তাদের খুঁজে বের করে সামনে আনতে হবে। তাদের হাত দিয়ে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করতে হবে, না হলে আওয়ামী লীগকে এক ভয়ঙ্কর পরিণতি বরণ করতে হবে।
Comments
Leave a Comment