অতীতে ‘প্রতিশ্রুতি’ রাখেনি বিএনপি, এবার রাখবে?
৫ আগস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের দেশে এখন সংস্কার উৎসব চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে ১০ টি সংস্কার কমিশন ঘোষণা করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও এ নিয়ে তৎপর। তারাও সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে জাতির সামনে হাজির হচ্ছে, জাতির কাছে বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রুতির কথা ব্যক্ত করছে। তাদের প্রতিশ্রুতির পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে কিংবা জনসমর্থন আদায়ে বিভিন্ন ধরনের সভা সেমিনার আয়োজন করছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে একটি হোটেলে বিএনপির উদ্যোগে ‘৩১ দফা রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে দলটির পক্ষ থেকে জনগণকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে যে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ নিশ্চিত করবে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও স্বৈরাচারী হয়ে যেন ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারেন সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। আরও নানা রকম প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকারের কথা বলছে বিএনপি। দলটির এমন অঙ্গীকার এবং সাম্প্রতিক সময়ে তাদের কার্যক্রম বেশ প্রশংসিতও হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। অনেকে বিএনপির এমন অবস্থানকে ‘দায়িত্বশীল আচরণ’ বলে ব্যাখ্যা করছেন। তবে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কি করবে, না করবে সেটি সময়ই বলবে। সেটি একটি ভিন্ন আলোচনাও বটে। এ ব্যাপারে পূর্বানুমান করাটাও সমীচীন হবে না। কিন্তু আমরা যদি একটু আমাদের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখি তাহলে দেখব যে, এধরনের প্রতিশ্রুতি শুধু প্রতিশ্রুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ক্ষমতায় গেলে সবাই সবকিছু ভুলে যায়।
আমরা যদি স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কথাই ধরি, তাহলে দেখব যে, তিন জোটের রূপরেখায় উল্লেখ ছিল এরশাদের পতনের পর সরকার কেমন হবে, সংসদ কেমন হবে, গণতন্ত্রের চেহারাটা কেমন হবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কেমন হবে- সেটি। সেখানে স্বচ্ছ নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদলের কথা ছিল। স্বাধীন গণমাধ্যমের কথা ছিল। গণতন্ত্রের প্রতি, ভোটের অধিকারের প্রতি কমিটমেন্ট ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে যারাই ক্ষমতায় এসেছে কেউই তা বাস্তবায়ন করেনি। সবাই সেই রূপরেখাকে উপক্ষোই করেছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের যে ঐতিহাসিক যাত্রা ১৯৯১ সালে শুরু হয়েছিল সে সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে বিএনপি। সেই অর্থে স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যে তিন জোটের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়েছিল সেটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তায় বিএনপির উপরই। কিন্তু তারা সে পথে হাটেনি।
১৯৯১ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও সে ধরনের সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে ছিল না। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সে নির্বাচন হয়েছিল। ফলে ১৯৯৬ সালের তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপিই সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু পরে আবার সেটিকে বিতর্কের মুখে ফেলে দেয়। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে তারা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর নেবার বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করেছিল। এর একটি বিশেষ কারণ ছিল দলটির। কারণ, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু ছিল। আর সংবিধান অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান। আর এ কারণে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কেএম হাসান অবসরের পরপরই যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন সেই ব্যবস্থা করা। উল্লেখ্য যে, কেএম হাসানকে প্রধান বিচারপতি করতে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছিল সে সময়। সেই অর্থে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের পথ বিএনপিই দেখিয়েছে এবং নির্বাচন ব্যবস্থাকে তারাই বিতর্কিত করেছে।
এছাড়াও রূপরেখায় ‘রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আচরণবিধি’ নামে একটি অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর হয়েছিল, যেটি জনসমক্ষে প্রকাশও করা হয়। সেই অঙ্গীকারনামায় ধারায় বলা হয়েছিল, ‘আমাদের তিনটি জোটভুক্ত দলসমূহ ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা এবং অপর দলের দেশপ্রেম ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কটাক্ষ করা থেকে বিরত থাকবে। আমাদের জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহ সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় প্রদান করবে না। এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণা সমবেতভাবে প্রতিরোধ করবে।’ কিন্তু ২০০৪ সালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে প্রতিহিংসার সংস্কৃতি প্রবর্তিত হয়। যা পরবর্তীতে রাজনীতিকে আরও অসহিষ্ণুতা দিকে টেলে দেয়।
৫ আগস্টের পর এখন বিএনপি সংস্কারের কথা বলছে। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলছেন। দলটির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র কাঠামোর ৩১ দফা ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও ২০২২ সালেই তারা এটি ঘোষণা করেছে। কিন্তু তাদের শাসনামলেই প্রধানমন্ত্রীর পদকে নিরঙ্কুশ ভাবে ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। এখন আবার নতুন করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করার কথা বলা হচ্ছে। ফলে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কতটুকু কি করবে?- এই প্রশ্নটি রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভিন্ন মহলে চর্চা হচ্ছে। সুতরাং বিএনপিকে আয়নায় আগে নিজেদের মুখ দেখতে হবে। তাদের অতীতের কার্যক্রমগুলোর আত্মমূল্যায়ন করতে হবে। কৃতকর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হবে। তাহলেই মানুষ বিশ্বাস করবে যে, ক্ষমতায় গেলে তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে। নয়তো মানুষ ভাববে অতীতের মতোই আবার হয়তো বিএনপি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে।
Comments
Leave a Comment