একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা: ইতিহাস যে সাক্ষী দেয়
সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি দাবি করেন, জামায়াতে ইসলামী এক পাকিস্তান চাইলেও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল না। কিন্তু ইতিহাস বলে জামায়াতে ইসলামী আমিরের এই বক্তব্য সঠিক নয়। আসুন দেখে নিই রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ এর লেখা ‘জামায়াতে ইসলামী উত্থান বিপর্যয় পুনরুত্থান’ গ্রন্থটি কি সাক্ষ্য বহন করে। আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালায়। পুলিশ, ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) ও সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে প্রতিরোধ যুদ্ধের সূচনা ঘটায়। পরে সর্বস্তরের মানুষ তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। এটাই এ দেশের ইতিহাসে 'মুক্তিযুদ্ধ' হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এটাই ছিল স্বাধীনতার লড়াই।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কয়েকটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এবং অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়। তাদের মধ্যে ছিল মুসলিম লীগ, পিডিপি, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম পার্টি, কৃষক- শ্রমিক পার্টি (কেএসপি) এবং চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির একাধিক গ্রুপ। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করলে দেশ শত্রুমুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসজুড়ে চলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তাণ্ডব। অগণিত মানুষ নিহত হয়। লাঞ্ছিত হয় লাখ লাখ নারী। প্রায় এক কোটি লোক প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়।
পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকার দেখাতে চেয়েছিল, দেশে অসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে ডা. আবদুল মোতালেব মালিককে ৩১ আগস্ট গভর্নর নিয়োগ করা হয়।
ডা. মালেক একটি অসামরিক মন্ত্রিসভা গঠন করেন। নতুন মন্ত্রিসভায় আটটি দলের ১২ জন ও একজন নির্দলীয় সদস্য ছিলেন। তাঁরা হলেন: আবুল কাশেম ও নওয়াজেশ আহমাদ (কাউন্সিল মুসলিম লীগ), আখতার উদ্দিন আহমদ (কনভেনশন মুসলিম লীগ), মুজিবুর রহমান (কাইয়ুম-সবুর গ্রুপের মুসলিম লীগ), আব্বাস আলী খান ও এ কে এম ইউসুফ (জামায়াতে ইসলামী), মাওলানা ইসহাক (নেজামে ইসলাম), ওবায়দুল্লাহ মজুমদার ও অধ্যাপক শামসুল হক (আওয়ামী লীগ), এ এস এম সোলায়মান (কৃষক-শ্রমিক পার্টি) জসিমউদ্দিন ও এ কে মোশাররফ হোসেন (পিডিপি) এবং মং সু প্রু চৌধুরী (পার্বত্য চট্টগ্রাম)
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ মুক্ত হয়। ওই সময় উল্লিখিত পাকিস্তানপন্থী দলগুলোর বেশিরভাগ নেতা বাংলাদেশেই ছিলেন। তাঁরা গ্রেপ্তার হন। ওই সময় (পশ্চিম) পাকিস্তানে ছিলেন উল্লেখযোগ্য নেতাদের মধ্যে নুরুল আমীন, মাহমুদ আলী ও গোলাম আযম। তাঁদেরসহ আরও অনেকের নাগরিকত্ব বাতিল হয়।
আটককৃত নেতারা প্রায় সবাই ১৯৭৩ সালের নভেম্বরে সাধারণ ক্ষমতার আওতায় ছাড়া পান এবং পরবর্তীতে রাজনীতিতে আবারও সক্রিয় হন।
পাকিস্তানপন্থি দলগুলের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল জামায়াতে ইসলামী। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে এ দলটি ভোটের হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দলের অনেক নেতা-কর্মী মানবতাবিরোধী নানান তৎপরতায় লিপ্ত ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের তারা ভারতের চর ও দুষ্কৃতকারী বলত এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে তারা যৌক্তিক মনে করত। তারা পাকিস্তান রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম রক্ষার কথাও বলত।
ওই সময় পাকিস্তানপন্থী দলগুলো, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদপত্রে অনেক খবর ও মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। ওইসব খবর ও মন্তব্য থেকে একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকার অনেকটাই বোঝা যায়। এখানে নির্বাচিত কিছু সংবাদ উদ্ধৃত করা হলো।
দৈনিক পাকিস্তান, ৬ এপ্রিল
জনাব নূরুল আমীনের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের ১২ জন রাজনৈতিক নেতার একটি প্রতিনিধিদল 'খ' অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন (প্রতিনিধিদলের একজন ছিলেন গোলাম আযম)।
দৈনিক আজাদ, ১১ এপ্রিল
ভারতের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে গোলাম আযম
বস্তুত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী প্রেরণ করিয়া ভারত পূর্ব পাকিস্তানিদের দেশপ্রেমকে চ্যালেঞ্জ করিয়াছে। ভারতের ইহা স্মরণ রাখা উচিত যে, একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য বৈদেশিক সশস্ত্র বাহিনী হস্তক্ষেপ করে না। আমি বিশ্বাস করি যে, এই সব অনুপ্রবেশকারী পূর্ব পাকিস্তানি মুসলমানদের নিকট হইতে কোনো সাহায্যই পাইবে না।
দৈনিক সংগ্রাম: ২১ মে
জামাত নেতৃদ্বয়ের বিবৃতি: প্রদেশের মুসলিম জনগণ ভারতের দখলদারদেরকে বরদাশত করবে না।
পূর্ব পাকিস্তান জামায়াত এছলামীর সাধারণ সম্পাদক এবং শ্রম সংক্রান্ত সম্পাদক মোহাম্মদ শফিকুল্লাহ গতকাল এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, পরিশেষে পাকিস্তানবিরোধী দুষ্কৃতকারী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী দ্বারা সৃষ্ট সন্ত্রাসের রাজত্ব এবং গোলযোগের উপর মারাত্মক আঘাত হানা হইয়াছে এবং মহাশক্তিশালী আল্লাহতালার অসীম অনুগ্রহে পাকিস্তান রক্ষা পাইয়াছে। এখানকার মোছলেম জনসাধারণ পাকিস্তানবিরোধী ও ভারতীয় দালালদের আর বরদাশত করিবে না এবং পাক মাটি হইতে তাহাদের সম্পূর্ণরূপে উৎখাতকল্পে জনগণ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলিয়া তাহারা আশা প্রকাশ করেন।
চলবে...
Comments
Leave a Comment