গণ-অভ্যুত্থানের ১০০ দিন: প্রত্যাশার চেয়ে হতাশা বেশি
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ১০০তম দিন আগামী ১৫ নভেম্বর। গণ-অভ্যুত্থানের আগে এটি ছিল নিতান্তই একটি কোটা সংস্কার আন্দোলন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা ক্রটিপূর্ণ, বৈষম্যমূলক। এর একটি যৌক্তিক সংস্কার সময়ের দাবী। আস্তে আস্তে এই কোটা সংস্কার আন্দোলন গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয় এবং দেশে একটি গণ-অভ্যুত্থান ঘটে। এই অভ্যুত্থানের পর বলা হয় একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ এর কথা, একটি ‘বৈষম্যমুক্ত দেশ’ গড়ার কথা। অঙ্গীকার করা হয় সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করে একটি বৈষম্যবিহীন বাংলাদেশের, পুরো ‘বাংলাদেশ একটি পরিবার’ হয়ে উঠার। এই অঙ্গীকারে সবাই এক ‘নতুন বাংলাদেশ’ এর স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, ‘নতুন বাংলাদেশ’ এর জাল বুনতে শুরু করে। কিন্তু এই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী ১০০ দিনের সমীকরণ বেশ হতাশার, আক্ষেপের!
গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রত্যাশা ছিল যে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা হবে বাঁধাহীন। যেখানে আমরা সবাই মুক্ত চিন্তা করতে পারবো, পরস্পরের প্রতি একটা শ্রদ্ধা এবং ভ্রাতৃত্ববোধের সমাজ গড়ে তুলবো, যেখানে কোন ভেদাভেদ থাকবে না। কিন্তু অভ্যুত্থানের পরবর্তী এই তিন মাসে আমাদের সমস্ত প্রত্যাশা যেন ‘গুড়েবালি’তে পরিণত হয়েছে। অভ্যুত্থানের পর দেখা গেলো সারা দেশ জুড়ে লাঞ্ছনার মঞ্চায়ন। জোর করে শিক্ষকদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এটি শুধু পদত্যাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। কোথাও কোথাও শিক্ষকদের রীতিমতো শারীরিক ভাবে লাঞ্ছনা এবং অপদস্থ করা হয়েছে। এর ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে আমাদের শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি। বাঙালীর যে হাজার বছরের সংস্কৃতি আছে বড়দের সম্মান করা, শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করা, সালাম দেয়া-এগুলো যেন হঠাৎ করেই আমাদের কাছে অপরিচিত হয়ে ধরা দিয়েছিল। পাশাপাশি সারা দেশে যেন মামলা করার এক বীভৎস প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ব্যক্তি আক্রোশ থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে স্বৈরাচার সরকারের দোসর অ্যাখ্যা দিয়ে নজীরবিহীন মামলা করার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে অভ্যুত্থানের পর ‘নতুন বাংলাদেশে’। মব জাস্টিস যেন আমাদের সংস্কৃতি চর্চায় রূপ নিয়েছিল। সারা দেশে বাঁধাহীন ভাবে মব জাস্টিসের চর্চা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সামনে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল হোসেনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে গিয়ে পৌঁছেছিল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সুস্পষ্টভাবে বক্তব্য রেখেছে কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গণহারে যেভাবে সাংবাদিকদের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে তাতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মাত্র তিন মাসের মাথায় নতুন করে আবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে বেশি যে শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে তা হল ‘বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ’। অথচ এখন সব ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগ তোলা হচ্ছে। খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগকারীও খোদ এই সরকারের অংশীজন। এই অভিযোগ প্রথম তুলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। তিনি এই সরকারের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক বৈষম্যের অভিযোগ তুলেছেন। এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘শুধু ১টা বিভাগ থেকে ১৩ জন উপদেষ্টা; অথচ উত্তরবঙ্গের রংপুর, রাজশাহী বিভাগের ১৬টি জেলা থেকে কোনো উপদেষ্টা নাই! তার উপর খুনি হাসিনার তেলবাজরাও উপদেষ্টা হচ্ছে!’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৪ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের অন্তত ১৩ জনের জন্মস্থান চট্টগ্রাম বিভাগে। অভিযোগ রয়েছে এই ১৩ উপদেষ্টার দপ্তর-উপ দপ্তরেও তাঁদের নিজস্ব এলাকার ব্যক্তিদের গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঢাকা বিভাগের রয়েছেন ৭ জন। খুলনা ও বরিশাল বিভাগের একজন করে আছেন। একক জেলা হিসেবে চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লা জেলা থেকে উপদেষ্টা হয়েছেন বেশি। অথচ যে আবু সাঈদের রক্তে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন রুপ নিয়েছিল গণঅভ্যুত্থানে, যে আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল রংপুর, সেই আবু সাঈদের রংপুর থেকে উপদেষ্টা পরিষদে কারো ঠাঁই হয়নি। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ছাত্র-জনতা। উত্তরবঙ্গের আরেক বিভাগ রাজশাহী থেকেও কোন উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়নি। আঞ্চলিক এই বৈষম্য দূর করতে রংপুরে দফায় দফায় বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষাভকারীরা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে উত্তরাঞ্চল থেকে ১০ জন উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া না হলে কঠোর আন্দোলনের হুমকিও দিয়েছে। এই বৈষম্য দূর করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কর্মসূচিও পালন করা হয়।
শুধুমাত্র উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে এমন নয়। প্রশাসনের মধ্যেও বৈষম্যের অভিযোগ রয়েছে। ৫ আগস্টের আগে প্রশাসনের যারা বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন, তাঁরা এই অভ্যুত্থানের পর নতুন করে স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করেছিলেন। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে যেভাবে বাধ্যতামূলক অবসর, ওএসডি করা হচ্ছিল, তাঁতে তারা আশান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু খুব দ্রুতই তাঁরা হতাশার স্রোতে নিমজ্জিত হয়। স্বৈরাচারের দোসর খোঁজার নামে প্রশাসনে শুরু হয়েছে নতুন করে বৈষম্য। খোঁজ চলছে ‘আমাদের লোকের’। আগের সমস্ত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে আবার পুরনোদের কাজে ফেরানো হয়েছে। এতে যাঁদের সচিব হওয়ার কথা সেই ব্যাচগুলোতে হতাশা বিরাজ করছে। বর্তমানে ছয়টি মন্ত্রণালয়-বিভাগের সচিবের পদ খালি রয়েছে। বিভিন্ন অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ উইংয়ের পদও ফাঁকা। কিন্তু এসমস্ত পদ পূরণ চলছে ধীরগতিতে, খোঁজা হচ্ছে ‘আমাদের লোক’। অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে সচিবালয়ে ‘আন্দোলন আতঙ্কে’ প্রহর গুনতে হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। কথায় কথায় সচিবালয়ে ঘেরাও কর্মসূচি হচ্ছে। কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে রাখার একাধিক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে ইতিমধ্যে। এর বাইরের সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগে বাতাস যেন ধীরে ধীরে ভারি হয়ে উঠছে। মীমাংসিত বিষয়গুলোতে নতুন করে বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে নিত্য নতুন বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে। ফলে সমাজের মধ্যে নতুন করে এক ধরনের ভেদাভেদ বা বিভক্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অথচ আমাদের অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্যই ছিল সকল প্রকার বিভেদ দূর করা। সবাইকে নিয়ে ‘একটি পরিবার’ হয়ে উঠার।
গণ-অভ্যুত্থানের দিন ৫ আগস্টে গোটা জাতি সেদিন সড়কে নেমে অঙ্গীকার করেছিল নতুন বাংলাদেশের, একত্রে মিলেমিশে থাকতে। কিন্তু সমাজের সর্বত্র আজ অস্থিরতা ছাপ। চুরি, ডাকাতি আর রাহাজানি মানুষের শান্তির ঘুমকে গ্রাস করে ফেলেছে। আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি তৈরি পোশাক শিল্পে চলছে চরম অস্থিরতা। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও শ্রমিকদের বিক্ষোভ হচ্ছে, সড়ক অবরুদ্ধ করে রাখার খবর শোনা যাচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিয়ালে সেক্টরে প্রায় ৬০০ শতাধিক বিক্ষোভ হয়েছে, যার অধিকাংশ ছিল সহিংসমূলক। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির ফলে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির একটি অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হতো এই সেক্টরে চাঁদাবাজি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সবার প্রত্যাশা ছিল চাঁদাবাজির রাজত্বের এবার শেষ দেখবে। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম যেমন কমেনি, তেমনি চাঁদাবাজিকে নতুন করে চিনেছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। চাঁদা না দেয়ার ফলে রীতিমতো প্রকাশ্যে হামলা হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।
এই গণ-অভ্যুত্থানের পেছনে সবচেয়ে বেশি যাদের অবদান আছে অর্থাৎ আন্দোলনে গিয়ে যারা আহত হয়েছেন, যাদের অঙ্গহানি হয়েছে, যারা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন তাঁরাও প্রকাশ্যে বৈষম্য শিকারের অভিযোগ করছেন। সর্বশেষ গতকাল বুধবার তাদের রাস্তায় অবস্থান করতে দেখা যায়। বৈষম্যের অভিযোগ তুলে সরকারের ভূমিকা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। গতকাল দিনভর চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) সামনের সড়কে অবস্থান করে বিক্ষোভ করেছে ছাত্র-জনতার আন্দোলন আহত ব্যক্তিরা।
এদিকে এই আন্দোলনের সূত্রপাত সেই কোটা সংস্কার ইস্যু নিয়েও তরুণসমাজের মধ্যে হতাশা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকারি চাকুরিতে ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের বিধান রেখে হাইকোর্টের আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছিল তা নিয়ে এখন করে বিভ্রান্ত দেখা দিয়েছে। আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এটিকে এখনো বৈষম্যমূলক মনে করছে। অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রায় তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেনি সরকার। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখান করেছে। তিনটি বিসিএস কার্যত আটকে আছে। নিয়োগের প্রক্রিয়াতেও কোনো গতি নেই। এতে চাকরিপ্রার্থীরা অনিশ্চয়তায় দিন পার করছেন। এরকম প্রতিটি বিষয়ে অনিশ্চয়তার ছাপ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যা এই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে আড়াল করছে আস্তে আস্তে।
Comments
Leave a Comment