Post Thumbnail

কঠিন পরিস্থিতিতে ‘আমলাতন্ত্র’


শান্ত সিংহ: গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ শাসনামলে দেশে আমলাতন্ত্রের বাড়বাড়ন্ত ছিলো। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে বিভিন্ন জেলার দায়িত্ব সচিবদের দেয়ার মধ্য দিয়ে এই চর্চার পাক্কাপোক্ত হয়। পরে এর বিস্তৃত আরো ছড়িয়ে পড়ে। আমলারা যেন আওয়ামী লীগের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার হয়ে গিয়েছিলো এসময়। চাকরীর বয়স শেষ হলেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে নিজের কর্তৃত্ব ধরে রাখার এক দৃশ্যমান প্রবণতা ছিলো তাদের। নির্বাচন কমিশন থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন; পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে শুরু করে তথ্য অধিকার কমিশন—সর্বত্র আমলাদের জয়-জয়কার। আমলাদের এমন ক্ষমতা চর্চার বিষয়টি জাতীয় সংসদে পর্যন্ত আলোচনা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ তোফায়েদ আহমেদ এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু এটি নিয়ে সংসদে আমলাদের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। আমলাতন্ত্রের কাছে নিজের অসহায়ত্বের কথা নির্দ্বিধায় সংসদে বলেছিলেন। কিন্তু এরপর আমলাদের ক্ষমতা কমেনি। বরং সব জায়গায় তাঁদের কর্তৃত্ব এবং দৌরাত্ম্য দুটোই বেড়েছে। কিন্তু ৫ আগস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর এই চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। আমলাতন্ত্র এখন এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে দেশের আমলাতন্ত্র। আমলারাও যেন স্তিমিত হয়ে পড়েছেন। সাম্প্রতিক সময় আমলাদের নামে হত্যা মামলার ঘটনা এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শীর্ষ  কর্মকর্তাদের নামে একের পর এক মামলা হচ্ছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই হত্যা মামলা। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক ক্রীড়া সচিব মেজবাহ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব আমিনুল ইসলাম খান, ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র, সাবেক নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন সহ প্রায় এক ডজন সাবেক আমলা গ্রেপ্তার হয়েছেন। এভাবে ঢালাও মামলা এবং গ্রেপ্তারের কারণে আমলাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। 

সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, শুধুমাত্র একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় ৫৩ জন সাবেক সচিবকে আসামি করা হয়েছে। এদের প্রতেক্যে ‘ভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট’ অভিহিতে মামলার এজহারে অভিযোগ করা হয়েছে। এরকম একটি মামলার খবরে বিস্ময় প্রকাশ করছেন আইনজ্ঞ ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, এসমস্ত মামলা কাউকে হেনস্তা করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে করা হচ্ছে। এসমস্ত মামলায় অভিযুক্তদের আদালতে দোষী প্রমাণ করা দুর্বিষহ। কারণ ঢালাওভাবে মামলা করা হচ্ছে। যার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র কাউকে হয়রানি করা। ইচ্ছে করে কাউকে এভাবে হেনস্তা করা ফৌজদারি দণ্ডবিধি অনুযায়ী অপরাধ। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য এ সমস্ত ঘটনা ঘটছে। যা অন্তত দুঃখজনক। এই মামলার খবরে আমলাদেরও অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ নিরাপদহীনতার কথাও বলছেন। তাদের কারো কারো অভিযোগ ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধ হাসিল না হওয়ার কারণে কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে এ ধরনের মামলা করতে পারেন। তবে যিনিই এটি করুক না কেন প্রশাসনের মধ্যে এটি একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাদেরকে আরো আতঙ্কিত করে তুলবে। যা হয়তো পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থাকেই স্থবির করে তুলবে। আমলা বলছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমলাদের বিরুদ্ধে এমন মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা কখনো ঘটেনি। তাদের দাবি, আমলারা কেবল বিগত সরকারের আদেশ বাস্তবায়ন করেছেন। তবে যাঁরা সীমা লঙ্ঘন করেছেন, বাড়াবাড়ি করেছেন, তাঁদের বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু যেভাবে শীর্ষ কর্মকর্তাদের নামে ঢালাও মামলা হচ্ছে, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে—তাতে অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এতে প্রশাসনের কাজে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে। যাঁরা অবসরে গেছেন, তাঁরাও এখন গ্রেপ্তার আতঙ্কে আছেন।

উল্লেখ্য যে, গত ২৯ অক্টোবর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি হত্যাচেষ্টার মামলা দায়ের করা হয়েছে। যেখানে রাজনীতিদের পাশাপাশি ৫৩ জন সচিবকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অভিযুক্তদের তালিকায় আছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার, সাবেক মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, আব্দুস সোবহান সিকদার, তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ, সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন আহম্মেদ, আরেক সাবেক সচিব নাছিমা বেগমক, আব্দুর রউফ তালুকদার, পিএসসি’র সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, মোজাম্মেল হক খান, জুয়েনা আজিজ, ফরিদ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, হেলালুদ্দীন আহমেদ, ফয়েজ আহমেদ, সাজ্জাদুল হাসান, সালাহ উদ্দিন, লোকমান হোসেন মিয়া, আব্দুল মান্নান, আব্দুল মান্নান হাওলাদার, আবু হেনা মোরশেদ জামান, ওয়াহিদা আক্তার, হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, মাকছুদুর রহমান পাটোয়ারী, মহিবুল হক, উজ্জল বিকাশ দত্ত, জাহাংগীর আলম, এম এ এন সিদ্দিক, শাহজাহান আলী মোল্লা, শ্যামল কান্তি ঘোষ, ইকবাল খান চৌধুরী, মরতুজা আহমেদ, খন্দকার শওকত হোসেন, নিয়াজ উদ্দিন মিয়া, জাফর আহম্মদ খান, বরুণ দেব মিত্র, এম আসলাম আলম, রফিকুল ইসলাম, চৌধুরী মো. বাবুল হাসান, সুরাইয়া বেগম, নজরুল ইসলাম খান, শহীদউল্লা খন্দকার, আব্দুল মালেক, জিল্লার রহমান, ইবরাহীম হোসেইন খান, সম্পদ বড়ুয়া, পবন চৌধুরী, অপরুপ চৌধুরী, সামছুদ্দিন আজাদ চৌধুরী, আক্তারী মমতাজ, শাহ কামাল ও প্রশান্ত কুমার রায়।

এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে এমনিতেই প্রশাসনের মধ্যে এক ধরনের স্থবিরতা দৃশ্যমান হয়েছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ফলে প্রশাসনের অনেক শীর্ষ আমলাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যাকে ওএসডি করা হয়েছে। কথায় কথায় আমলাদের একটি অংশকে আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টাও দৃশ্যমান। একই সঙ্গে আবার পুরনোদের প্রশাসনে ফিরিয়ে এনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এবং পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে, যেখানে আগে থেকেই প্রশাসনের মধ্যে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে আমলাদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ ছিলো। এখনো সেটা অব্যাহত থাকার ফলে এই অসেন্তাষ আরও বাড়ছে বলে ধারণা করা হয়। যা গোটা প্রশাসনকেই স্থবির করে তুলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টা বিভিন্ন সময় প্রশাসনের মন্থরতা কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। এরকম বাস্তবতায় অনেক আমলা নিজেদেরকে কিছুটা হলেও গুটিয়ে নিচ্ছেন। ফলে আমলাতন্ত্র এখন এক কঠিন সমীকরণের মুখে পড়েছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সর্বশেষ ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও আমলাদের এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়নি। তখন আমলাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করেছিল। হাতে গোনা দু-একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বটে কিন্তু সেবার এখনকার মতো আতঙ্ক প্রশাসনে দেখা যায়নি।


Comments

Leave a Comment


Related Articles