

দিল্লী-বিএনপির সমঝোতা: রাজনীতিতে নতুন টার্নিং পয়েন্ট?
৫ আগস্টের পর আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে বিএনপি। ৫ আগস্টের সময় বিএনপির নেতারা যে ভাষায় আওয়ামী লীগ এবং ভারত বিরোধিতা করেছিল, তিন মাস পরে তার অবস্থান একেবারেই বিপরীত। শুধু ভারত বিরোধিতা বা আওয়ামী লীগ বিরোধিতা না, বিএনপির বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি মৌলিক পরিবর্তন লক্ষণীয়। বিএনপি যেন আগের মতো নেই। প্রতিদিন দলটি নতুন রূপে আবিষ্কৃত হচ্ছে। বদলে যাওয়ার কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করছেন বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার পথে কোন বাধা রাখতে চায় না। যে কারণেই দলটি এখন দিল্লীর সাথে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে বিএনপির একটি সমঝোতার প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনীতির মাঠে নানা গুঞ্জন। সম্পন্ন হয়েছে। বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা ভারতের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছেন, এ খবর এখন আকাশে-বাতাসে। আগামীতে সরকার গঠন করলে বিএনপি কীভাবে দেশ পরিচালনা করবে তার একটি ধারণাও তাঁরা জনগণের কাছে দিতে চাইছে।
বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতা মনে করেন, ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী। ভারতকে অখুশি রেখে বা ভারতের সঙ্গে বৈরীতা করে বাংলাদেশে সরকার পরিচালনা করা সহজ হবে না। আর এই কারণেই ভারতের সঙ্গে বিএনপির পক্ষ থেকে বোঝাপড়ার উদ্যোগ নেয়া হয় ৫ আগস্টের পর থেকে। অবশ্য বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা বলেছেন যে ৫ আগস্টের অনেক আগে থেকেই ভারতের সঙ্গে বিএনপি একটি সুসম্পর্ক চেয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের একটা দ্বিপাক্ষিক সম্মানজনক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ভারতের মৌলিক পররাষ্ট্রনীতিরই একটি অংশ। তবে ৫ আগস্টে বাংলাদেশে যেভাবে ভারত বিরোধী একটি গণ বিস্ফোরণ তৈরি হয়েছিল সেখান থেকে পরিস্থিতিকে স্তিমিত করার জন্য দিল্লির সামনে বিএনপি ছাড়া অন্য কোন বিকল্প ছিল না। আর এ কারণেই দিল্লি আগ্রহ দেখায় বিএনপির সঙ্গে সুসম্পর্ক করার জন্য। তারই ভিত্তিতে বিজেপি এবং বিএনপির মধ্যে দীর্ঘ আলাপ আলোচনার সূচনা। বিএনপির দলীয় সমঝোতা কিছু কিছু ফল আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। যেমন একজন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম যিনি বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ফেলেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তার তীব্র সমালোচনা করে আজকে বলেছেন যে, বঙ্গভবন থেকে শেখ মুজিবের ছবি নামিয়ে ফেলা উচিত হয়নি। খন্দকার মোশতাক নামিয়ে ছিলেন, জিয়াউর রহমান টাঙিয়ে ছিলেন। যদিও মাত্র কয়েক ঘণ্টার পর তিনি তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন। এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। কিন্তু এটি বিএনপির বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ভারতীয় জনতা পার্টির প্রভাবশালী নেতা অমিত শাহ’র সাথে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
শুধু রিজভী আহমেদের এই বক্তব্যই নয়, গত দুই মাস ধরে যদি আমরা বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব যে বিএনপির অবস্থানের একটা মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। যেমন, বিএনপি রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছে। শিক্ষার্থীরা এবং বিভিন্ন মহল যখন চাচ্ছিলেন রাষ্ট্রপতিকে ছুড়ে ফেলে দিতে, তাঁকে অপসারণ করতে, বিএনপি সেই সময় তাদের অবস্থান পৃথক অবস্থান জানান দেয়। তাঁরা বলে যে তাঁরা রাষ্ট্রপতির অপসারণ চায় না। এর ফলে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হবে। সাংবিধানিক শূন্যতার সুযোগ কেউ নিক এটা তাঁরা চায় না। বিএনপির এই অবস্থানের কারণেই রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবি থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ইনকিলাব মঞ্চ ইত্যাদি নানা রকম গজিয়ে ওঠা সংগঠন সরে এসেছে।
জাতীয় পার্টি অফিস ভাঙচুরের ব্যাপারেও বিএনপির পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট অবস্থান নেয়া হয়েছে। তাঁরা যে কোন রাজনৈতিক দলের কার্যালয় ভাঙচুর করা, দখল করা ইত্যাদির তীব্র বিরোধিতা করেছে। তাঁদের এই অবস্থান সুস্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয়ার পর জাতীয় পার্টির উপর আক্রমণ, আক্রোশ ইত্যাদিও স্তিমিত হয়ে গেছে। বিভিন্ন মহল থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কথা বলা হচ্ছিল। সরকারের মধ্য থেকেও কয়েকজন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা বলছিলেন। কিন্তু বিএনপির শীর্ষ নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দুইজনই বলেছেন, তাঁরা নিষিদ্ধ রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না। তারেক জিয়া সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, এক একটি রাজনৈতিক দল থাকবে, কি নিষিদ্ধ হবে সেটা জনগণের ভোটে নির্ধারিত হবে। ভোটাধিকারের মাধ্যমেই একটি রাজনৈতিক দলের মৃত্যু ঘটবে। এটি একটি রাজনৈতিকভাবে বিচক্ষণ এবং দায়িত্বশীল কথা। একইভাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, কোন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হোক তা তাঁরা চান না। ফলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও ঝুলে গেছে।
সংবিধান সংশোধন সহ নানা বিষয়ে বিএনপির একটি মডারেট ডেমোক্র্যাটিক দল হিসেবে নিজেদের প্রমাণের চেষ্টা করছে প্রবলভাবে। একটি সহনীয় গণতান্ত্রিক অবস্থান দেখাতে চাইছে, যেখানে উগ্রবাদের স্থান নেই। এই অবস্থার পরিবর্তন কি আপনাআপনি হলো? বিএনপি কি ক্ষমতায় আসার জন্যই এই পরিবর্তন করছে? বিএনপির একজন নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন যে, এটি কোন পরিবর্তন নয়। বিএনপি সবসময় একটি লিবারেল দল। তাঁরা সবসময় পরম সহিষ্ণুতা এবং সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং জনগণের ক্ষমতায়নের বিশ্বাস করে। বিএনপি মনে করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোন উগ্রবাদের জায়গা নেই।আর এই অবস্থান বিএনপির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বলে ওই নেতার দাবি। কিন্তু বাস্তবতা হলো যে ৫ আগস্টের পর বিএনপির অনেক নেতা আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট বলে অভিহিত করেছিলেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার অধিকার নেই বলেও বর্ণনা করেছিলেন। সেখান থেকে বিএনপি সরে এসেছে। ৫ আগস্টের পর যদি বিএনপির একাধিক নেতার বক্তব্য দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে তারা রাষ্ট্রপতির অপসারণ চেয়ে ছিলেন। রাষ্ট্রপতিকে ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। এমনকি ৫ আগস্টের আগেও রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে বিএনপির ভয়ানক আপত্তি ছিল। সেখান থেকে বিএনপির এই অবস্থানে আসাটা শুধু বিএনপির রাজনীতি নয়, দেশের ররাজনীতিতেও টানিং পয়েন্ট। এই পরিবর্তনের কারণ হলো ক্ষমতা। বিএনপির মনে করছে আগামীতে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেই নির্বাচনে তাদের ক্ষমতায় আসার পথটি পরিষ্কার। নাটকীয় কোন কিছু না ঘটলে নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ বিজয় পাবে বলেই তাঁদের ধারণা। আর এই কারণেই তাঁরা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে একটি সহনশীল উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রমাণিত করতে চাচ্ছে। তারা প্রতিহিংসাপরায়ণ নয়, তাঁরা উগ্রবাদকে লালন করে না- এই বার্তা দিয়ে তাঁরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আস্থা অর্জন করতে চাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বিএনপি মনে করে যে, যদি রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকে তাহলে উগ্রবাদের উত্থান ঘটবে। বিশেষ করে জামায়াত এবং অন্যান্য যে উগ্রবাদী রাজনৈতিক শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে সেগুলো বিএনপির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি হবে। আর যতক্ষণ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা শক্তিশালী থাকবে। বাংলাদেশে যদি সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটে তাহলে বিএনপির বিবেচনায় সেটা তাদের জন্য একটা হুমকি হিসেবে আসতে পারে। কারণ বিএনপির যে আওয়ামী বিরোধী ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে সেই ভোটব্যাঙ্কের একটি বড় অংশই হল এই উগ্রবাদ এবং সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। তারা যখন তারা যদি বিএনপির বিপক্ষে যায় সেক্ষেত্রে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান বিপদাপন্ন হয়ে যেতে পারে। আর এই কারণেই একটি সহমর্মিতা এবং সমঝোতার রাজনীতির পথে এগোচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করে যে, বাংলাদেশের ৫ আগস্টের ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হল দিল্লী। কাজেই ভারতও কোন অবস্থাতেই এটি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছে না। আবার অন্যদিকে চটজলদি করেছে যে তাঁরা আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় বসাবে সেই সুযোগও নেই। কারণ তাঁরা অনুভব করতে পেরেছে যে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে একটা জনরোষ আছে, আছে নেতিবাচক জনমত। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে যে অপকর্মগুলো হয়েছে সেগুলোকে মানুষ এতো সহজে ভুলে যাবে না। এরকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা একটি অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়৷ আর এই কারণেই তাঁরা বিএনপির দিকে ঝুঁকেছে। বিএনপির সঙ্গে তাঁরা একটি সমঝোতার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে চায়। তবে কোন কোন বিশ্লেষক, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতির বিশ্লেষণ করছেন, গত ১৫ বছরে বিএনপির রাজনীতিতে কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। তারেক জিয়ার চিন্তা ভাবনায় কিছু বিষয় এসেছে। বিএনপি গত ১৭ বছর ধরে যে ভাবে নির্যাতিত, নিপীড়িত হয়েছে তাতে তাদের একটা বোধদয় তৈরি হয়েছে। আর এ কারণেই পাঁচ আগস্টের পর তাঁদের কতগুলো মৌলিক বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন যারাই দখল করছে বা লুটরাজ করছে তাঁদের বিরুদ্ধে বিএনপি ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করছে। এসবকে বিএনপির দলীয় ভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছে না। যেখানে যেখানে চাঁদাবাজি বা বলপ্রয়োগের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে সেখানে কমিটি বাতিল করে দেয়া হচ্ছে। জনগণ যে উগ্রবাদ পছন্দ করছে না এটি আলোকে তাঁরা প্রতিহিংসার বলয় থেকে বেরিয়ে একটি সহমর্মিতার রাজনীতির বার্তা দিতে চাচ্ছে। বিএনপি আসলে নিজেরাই প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে। কাজেই প্রতিহিংসার রাজনীতির যে ক্ষত, সেটা তাঁরা খুব ভালো মতোই অনুভব করতে পারে। সে থেকেই তাঁরা এই ভাবনায় বলে অনেকে ব্যাখ্যা দেন। তবে বিএনপির এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ভারত ভূমিকা রাখুক না রাখুক, বিএনপি যদি একটি লিবারেল এবং মডারেট গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ক্ষমতায় আসে তাহলে ভারতের চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না। সেজন্যই বিএনপির প্রতি বন্ধুত্বের হাত নতুন করে বাড়িয়েছে দিল্লী।
Comments
Leave a Comment