গণমাধ্যমে চলছে সাংবাদিক নিধন?
শান্ত সিংহ: দায়িত্ব গ্রহণের এক মাস পর গত ১১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘সংবাদমাধ্যম ও মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। আপনার মন খুলে আমাদের সমালোচনা করেন।’ এরপর ঠিক প্রায় এক মাস পর গত ১২ অক্টোবর কক্সবাজার প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেসসচিব সুচিস্মিতা তিথি একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে মন খুলে সমালোচনা করা যাবে। সরকার মিডিয়াকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে না। কোন নিউজের কেমন ট্রিটমেন্ট হবে, তা নিয়ে চাপ দেবে না সরকার।’ কিন্তু গত কয়েকদিনে সরকারের একটি পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত সরকারের এমন ঘোষণাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময় তিন দফায় ১৬৭ জন সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে তথ্য অধিদপ্তর। প্রথম দফায় গত ২৮ অক্টোবর ২০ জন, দ্বিতীয় দফায় গত ২ নভেম্বর ২৯ জন এবং সর্বশেষ ৭ নভেম্বর ১১৮ জন সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে সরকার। ২৮ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও সারা দেশে দুই শতাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। কারো কারো বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগও উঠেছে। এসমস্ত নামের তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দেশের মূলধারার গণমাধ্যমের বিভিন্ন দৈনিক, টেলিভিশনের সম্পাদক এবং সিনিয়র সাংবাদিকদের নামও উল্লেখ্য আছে। সাংবাদিকতায় যাদের কর্মক্ষম প্রশ্নাতীত এবং সাংবাদিকতা পেশায় যারা অনুসরণীয়ও বটে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাবেক সম্পাদক নঈম নিজাম, কালবেলার সম্পাদক সন্তোষ শর্মা, ডিবিসি’র সম্পাদক প্রণব সাহা, টিভি টুডে’র প্রধান সম্পাদক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, কালের কণ্ঠের ইমদাদুল হক মিলন, ডিবিসি’র প্রধান সম্পাদক মোহাম্মদ মঞ্জুরুল ইসলাম, দৈনিক জাগরণের সম্পাদক আবেদ খান, চ্যানেল আই-এর শাইখ সিরাজ, যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম, সৈয়দ ইসতিয়াক রেজা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দৈনিক, টেলিভিশন এবং অনলাইনের সিনিয়র সাংবাদিকদের নামও রয়েছে এই তালিকায়।
ধারণা করা হচ্ছে সরকার সংক্ষুব্ধ হয়ে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। যেহেতু এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করা হয়েছে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে সাংবাদিকদের একাংশকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ফ্যাসিবাদী সরকারের দোসর হিসেবে অভিহিত করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছে প্রকাশ্যে। সেখান থেকেই সাংবাদিক বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট মহলের অনেকে।
প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড হলো সরকার কর্তৃক স্বীকৃত একজন সাংবাদিকের পরিচয়পত্র। এটা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের তথ্য অধিদপ্তর থেকে ইস্যু করা হয়ে থাকে। এই কার্ডের মাধ্যমে একজন সাংবাদিক খবর সংগ্রহের জন্য কোন স্থানে বা প্রতিষ্ঠানের প্রবেশের জন্য অনুমতি পায়। বিশেষ করে সচিবালয়ে তাঁর প্রবেশাধিকার থাকে। এই কার্ড তাঁর শেপাগত দায়িত্ব পালন সহায়ক হিসেবে কাজ করে। অথচ সরকার সাংবাদিকদের এই কার্ড বাতিল করছে। একজন সাংবাদিকের ব্যক্তিগত আলাদা মতাদর্শ বা দর্শন থাকতেই পারে, তিনি একটি বিশেষ গোষ্ঠীর সমর্থক হতে পারেন, এটি তাঁর নাগরিক অধিকার। কিন্তু তাঁর সেই মতাদর্শকে কেন্দ্র করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ কিংবা তাঁকে কোন কিছু থেকে বঞ্চিত করা মোটেও একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের উদাহরণ হতে পারে না। আমরা যদি সদ্য অনুষ্ঠিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যালোচনা করি তাহলে দেখবো যে, এই নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী মূলধারার গণমাধ্যমগুলো রীতিমতো দুই শিবিরে বিভক্ত ছিলো। ডেমোক্রেটিক পার্টি কমলা হ্যারিসকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছিল দেশটির প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম সিএনএন। অন্যদিকে রিপাবলিক পার্টি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন জানিয়েছিল নিউ ইয়র্ক টাইমস, ফক্স নিউজ। তাই বলে কি হোয়াইট হাউজে নিউ ইয়র্ক টাইমস বা ফক্স নিউজের সাংবাদিক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে? হয়নি। বস্তুত গণতন্ত্রের সৌন্দর্যই হলো সেখানে আপনার শক্তিশালী প্রতিপক্ষ বা বিরুদ্ধ মতাদর্শী থাকবে। তিনি তাঁর মতামত প্রকাশ করতে পারবেন। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দৃষ্টান্ত। আপনার বিরুদ্ধ পক্ষ বা আপনার মতাদর্শের সাথে মিল নেই এমন পক্ষও যখন তাঁর মতামত প্রকাশে কোন দ্বিধা করবে না কিংবা কোন ভয়ের সংস্কৃতি থাকবে না তখনই মত প্রকাশের স্বাধীনতা পরিবেশ তৈরি হবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিকদের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিলের তালিকা যেভাবে দীর্ঘ হচ্ছে তাতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি আবার সামনে আসছে। সরকার সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করা চেষ্টা করছে কিনা সেই প্রশ্নটি উঠছে। একই সঙ্গে সরকার যে গণমাধ্যমকে প্রাণখুলে সমালোচনা করার আহ্বান জানিয়েছে সেই আহ্বানও এখন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
Comments
Leave a Comment