Post Thumbnail

ছাত্রশিবিরের নৃশংসতা: ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র প্রতিবেদন


সম্প্রতি ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ছাত্রশিবির রাজনীতিতে আবার প্রকাশ্য হচ্ছে। বিশেষ করে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংগঠনটি সক্রিয় উপস্থিতির কথা শোনা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ধাপে ধাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে এসেছে সংগঠনটি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবির আবার প্রকাশ্যে আসার ঘটনার প্রতিবাদে গত ২৯ অক্টোবর মধ্যরাতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল সংগঠনের নেতাকর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। উল্লেখ্য যে, ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ব্যাপক সহিংসতা এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগ আছে। ১৯৮৮ সালের ১১ নভেম্বর সাপ্তাহিক বিচিত্রা‘জামাত-শিবিরের সাম্প্রতিক নৃশংসতার খতিয়ান’ শিরোনামে শামসুদ্দিন আহমেদ ফরিদপুরীর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা যায়, তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এই প্রতিবেদন থেকে জামায়াত-শিবিরের নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের কিছু উদাহরণ সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।

মাওলানা আবদুস সোবহান হত্যা 

জামায়াত নেতা গোলাম আযম বাংলাদেশে আসার অব্যবহিত পর আলবদর বাহিনীকে নতুনভাবে সংগঠিত করতে গিয়ে ১৯৭৩ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার ভিন্নমতাবলম্বী ছাত্র নেতা সালাম আবদুস সোবহানকে শিবির কর্মীরা কোরান পাঠরত অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করে।

তবারক হত্যা

১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সহ সাধারণ সম্পাদক তবারক হোসেনকে শিবির কর্মীরা প্রকাশ্য দিবালোকে কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তবারক যখন পানি খেতে চেয়েছিল, তখন শিবিরের নরপিশাচরা তার মুখে প্রস্রাব করে দিয়েছিল। এই হত্যা মামলার পয়লা নম্বর আসামি আনোয়ার হোসেন এবং দুই নম্বর আসামি জাহাঙ্গীর কাশেম প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।

শাহাদৎ হত্যা

মাধ্যমিক পরীক্ষায় কুমিল্লা বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থান অধিকারী চট্টগ্রাম কলেজের কৃতী ছাত্র শাহাদৎ হোসেন নৌবাহিনীর এক ক্যাপ্টেনের ছেলে। প্রথমে সে ছাত্রশিবির করত। পরে বিরক্ত হয়ে সে শিবির ছেড়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেয়। এজন্য তাঁকে ১৯৮৪ সালের ২৭ মে রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় জবাই করে হত্যা করা হয়। আততায়ীর জবানবন্দি অনুযায়ী, এই হত্যাকাণ্ডের আগের দিন কামারের দোকান থেকে ধারালো কিরিচ অর্ডার দিয়ে তৈরি করে আনা হয়।

আবদুল হালিম হত্যা

১৯৮৪ সালের ১০ জুলাই চন্দ্রঘোনা তৈয়বিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসার ছাত্র ১১ বছর বয়সি ইসলামী ছাত্রসেনা কর্মী ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আবদুল হালিমকে শিবির কর্মীরা ঘুমন্ত অবস্থায় দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।

আবদুর রশীদ হত্যা

১৯৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজের ছাত্রলীগ নেতা আবদুর রশীদকে কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে হত্যার মাধ্যমে ছাত্রশিবির নববর্ষ উদ্যাপন করে। কলেজের দুজন শিক্ষকের ভাষ্য অনুযায়ী, আবদুর রশীদ নিয়মিত মসজিদে নামাজ পড়ত এবং ভদ্র প্রকৃতির। পরীক্ষা দিতে যাওয়ার পথে রশীদকে প্রথমে গুলি করা হয়। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে রশীদ পুকুরে লাফ দেয়। চারদিকে ঘেরাও করে রশীদকে পুকুর থেকে তুলে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

লিয়াকত হত্যা

চট্টগ্রাম কুয়াইশ বুড়িশ্চর কলেজের ডিগ্রি ক্লাসের ছাত্র লিয়াকত আলী ছিলেন ইসলামী ছাত্রসেনার একজন বিশিষ্ট নেতা। বিধবা জননীর সন্তান লিয়াকত আলী ইসলামের একজন পবন্দ ছিলেন যে, তিনি কোনোদিন তাঁর দাড়িতে খুর স্পর্শ করেননি। তিনি সবসময় অজু অবস্থায় থাকতে অভ্যস্ত ছিলেন এবং নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। ১৯৮৬ সালের ১০ এপ্রিল চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে ইসলামী ছাত্রসেনার উদ্যোগে আয়োজিত এক নবাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে ভাষণ দিয়ে অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পথে শিবির কর্মীরা তাঁকে কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।

হাটহাজারী মাদ্রাসা হত্যাকাণ্ড

১৯৮৬ সালের মধ্যভাগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এ এফ রহমান হল থেকে শিবির কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হাটহাজারী মাদ্রাসায় কমান্ডো হামলা চালিয়ে দুজন ভিন্ন মতাবলম্বী মাদ্রাসা ছাত্রকে হত্যা করে। মাদ্রাসায় দুজন প্রবীণ মোহাদ্দেসকেও তারা লাঠিপেটা করে জখম করে।

মাওলানা ফখরুল ইসলাম

১৯৮৬ সালে শিবির কর্মীরা চন্দনপুরা দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা ফখরুল ইসলামকে বেঁধে পিটিয়ে জখম করে এবং বুকে পিস্তল ধরে পদত্যাগপত্র আদায় করে।

রফিকুল ইসলাম হত্যা

চট্টগ্রামের ইসলামী ছাত্রসেনা কর্মী রফিককে শিবির কর্মীরা ১৯৮৬ সালে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের মূল কুশীলব হচ্ছে চট্টগ্রামের অসংখ্য ফৌজদারি মামলার আসামি পলিটেকনিকের শিবির সেনাপতি রেজাউল বারী।

আবদুল হামিদ ও জসীম

১৯৮৬ সালের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আবদুল হামিদকে শিবির নেতা আমীর হোসেন এবং তার সহকর্মীরা 'সালামালাইকুম' দিয়ে গুলি করে ধরাশায়ী করে। তারপর তার হাতটি ইটের ওপর রেখে কিরিচ দিয়ে কেটে বিচ্ছিন্ন করে এবং ওই কাটা হাতটি কিরিচের মাথায় গেঁথে বিজয় মিছিল করে। এরপর বহিরাগত সশস্ত্র কর্মী বাহিনী নিয়ে একযোগে সবগুলো ছাত্রাবাসে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের শতাধিক কর্মীকে আহত করে। ১৪ জন ছাত্র গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়। আবদুল হামিদ ও জসীমকে বিশেষ বিমানযোগে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে আনা হয়। হামিদ একটি হাত ও একটি চোখ হারায়। জসীমও চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়।

জামিল আখতার রতন হত্যা

১৯৮৮ সালের ৩১ মে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের পঞ্চম বর্ষের ছাত্র বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর কলেজ শাখার সভাপতি জামিল আখতার রতনকে জামায়াত-শিবির পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ১২.১০ মিনিটে হত্যা করে। চায়নিজ কুড়াল, কিরিচ ও ইট দিয়ে রতনকে মাথায় আঘাত করার পর তার মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত শিবির কর্মীরা অপেক্ষা করে। এর আগে ২৯ মে রাতে ইন্টার্নি ডাক্তার গৌতম চৌধুরীকে কুড়াল দিয়ে আঘাত করে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছুরিকাহত

১৯৮৮ সালের ৭ জুলাই চট্টগ্রামের হেদায়েত-শামসু গং-এর নেতৃত্বে সশস্ত্র শিবির কর্মীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা করে।

১ জুলাই রাত বারোটায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোজাহিদ হোসেন শিবিরের গুন্ডাবাহিনীর হাতে ছুরিকাহত হন। তাঁর কাছে একটি লাইসেন্স করা পিস্তল ছিল। শিবির কর্মীরা ওই পিস্তলটিও ছিনিয়ে নেয়।

সিলেটে জামায়াতের সন্ত্রাসে তিনজন নিহত

১৯৮৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সিলেটে জামায়াত-শিবিরের আক্রমণে মুনির ও তপন নিহত হয়। আর একজন জুয়েল একটি ভবনের ছাদে আশ্রয় নেয়। জামায়াত-শিবির কর্মীরা তাকে ধাওয়া করলে জুয়েল পাশের ছাদে যাওয়ার জন্য লাফ দেয় এবং পা ফসকে পড়ে মারা যায়। তারা তিনজনই ছাত্রলীগের কর্মী।

রেজাউল করিম নতুন হত্যা

কুড়িগ্রামের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী রেজাউল করিম নতুনকে জামায়াতে- শিবিরের মিছিল থেকে হামলা করলে সে নিহত হয়। তার মামা এমদাদুল হক জাসদের নেতা।

 


Comments

Leave a Comment


Related Articles