Post Thumbnail

অন্তর্বর্তী সরকার কী পথ হারিয়েছে?


আগামীকাল ৮ নভেম্বর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিনমাস পূর্তি হবে। যদিও একটি সরকারকে মূল্যায়ন করার জন্য তিনমাস সময় যথেষ্ট নয়। তবে যে কোনও সরকারের প্রথম একশ দিনকে বলা হয় ‘হানিমুন পিরিয়ড’। এই সময় সরকারের গতিপ্রকৃতি এবং সরকার কোন পথে যাচ্ছে সে সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। সরকারের সক্ষমতা এবং বিচক্ষণতা সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায় এই সময়। ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। এরপর তিনদিন দেশে কোনও সরকার ছিল না। প্যারিস থেকে এসে ড. মুহাম্মদ  ইউনূস ৮ আগস্ট রাতে বঙ্গভবনে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশকে একটি পরিবার হিসেবে অভিহিত করে সকলে মিলে নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। কিন্তু গত তিন মাসে বাংলাদেশ কী একটি পরিবার হতে পেরেছে? বাংলাদেশে কী মৌলিক কোনও পরিবর্তন এসেছে নাকি আমরা নতুন শঙ্কা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি। প্রতিহিংসার বদলে প্রতিশোধ গ্রহণের এই হিংস্র খেলা শুরু হয়েছে দেশজুড়ে। প্রথম যে বিষয়টি আলোচনা করা দরকার তা হল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের লক্ষ্য কী? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের লক্ষ্য নিয়ে এখন এক ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। গত তিন মাসে এই বিভ্রান্তি আরো বেড়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, নির্বাচনের জন্য সরকার নয়, বরং একটি গণ-অভ্যুত্থানের পর ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অনুভূতির অভিব্যক্তি প্রকাশ এই সরকার। কিন্তু এই সরকারের কোনও রাজনৈতিক অবয়ব নাই। যদি ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা থাকত, একটি জাতীয় সরকারের অবয়ব থাকত তাহলে এই সরকারের সময়সীমা এবং সরকারের লক্ষ্য নিয়ে এত আলোচনা হত না। বরং তখন আলোচনার বিষয় হত নতুন সরকারের কার্যপরিধি নিয়ে। নতুন সরকার কী কী কাজ করবে, কতদিনে করবে ইত্যাদি নিয়ে। কিন্তু এই সরকারটি যেহেতু একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে গঠিত হয়েছে এবং সরকারের ভেতর যাঁরা আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে মোটেও জড়িত ছিলেন না। এই সরকারে জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত  কয়েকজন। দুজন উপদেষ্টা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতা (নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ), ড. আসিফ নজরুল এবং সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান যাঁরা সরাসরি ভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু ড. সালেহউদ্দিন, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, এম সাখাওয়াত হোসেন, মো. জাহাঙ্গীর আলম, আলী ইমাম মজুমদার, তৌহিদ হোসেন সহ আরও বেশ কিছু উপদেষ্টা আছেন যাঁরা এই গণ-অভ্যুত্থানের সময় কোনরকম ভূমিকাই পালন করেনি। তাই এটি বিপ্লবী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে একটি অনির্বাচিত সরকার।

প্রশ্ন হল, এই নির্দলীয় কাঠামোর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসলে কতদিন কাজ করবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে বলা হচ্ছে যে, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান লক্ষ্য সংস্কার সম্পাদন করা এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সংস্কারগুলো সম্পন্ন না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা নির্বাচন দেবে না। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে বিশেষ করে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ হল জরুরি সংস্কার বা আশু প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে দ্রুত একটা নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা। একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্যে দেশকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যদি দেশ চলে তাহলে সেই দেশের জন্য ইতিবাচক হবে না বলে তাঁদের অভিমত। বিএনপি এখন আস্তে আস্তে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করছে। যেমন বিএনপি সরাসরি বলে দিচ্ছে যে সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেই। এই সরকারকে নির্বাচনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মৌলিক নীতি নির্ধারণের কোনও কাজ করতে পারবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা না করে-এমন বার্তাও দেয়া হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। ফলে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটা সুস্পষ্ট দূরত্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকারের কোনও কোনও উপদেষ্টার মধ্যে পরিপক্কতার অভাব বেশ ভালোভাবেই দৃশ্যমান। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সরাসরি বললেন যে রাষ্ট্রপতি শপথ ভঙ্গ করেছেন। আরেক উপদেষ্টা যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে উপদেষ্টা হয়েছেন, নাহিদ ইসলাম জানালেন যে রাষ্ট্রপতির অপসারণ সিদ্ধান্তটি সাংবিধানিক নয়, এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু প্রবল বাঁধার মুখে এই উপদেষ্টারা শেষপর্যন্ত তাঁদের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারলেন না এবং রাষ্ট্রপতিকে সরাতে পারলেন না। এর ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে হেরে গেল। কিন্তু এখানে জয়-পরাজয়ের চেয়ে বড় বিষয় হল এর মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপর রাজনৈতিক চাপ অনেক বেড়ে গেছে।  সামনের দিনগুলোতে এই চাপ সামলে নিতে পারবে ড. ইউনূসের সরকার? তারা কী নির্বাচনের পথে হাঁটবে নাকি দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারগুলো সম্পন্ন করার দিকে মনোযোগী হবে?

এ কথা অস্বীকার করার কোনও কারণ নেই যে, এই সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল তখন তার বিপুল জনসমর্থন এবং ম্যান্ডেট ছিল। সাধারণ মানুষের কাছে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। এই সরকারকে সবাই স্বাগত জানিয়েছিল। একই সঙ্গে মানুষ আশা করেছিল যে তাঁদের জীবনযাত্রা সুন্দর হবে, তাঁরা অতীতের যে দুঃখ গ্লানি এবং খারাপ অবস্থা সেখান থেকে একটা স্বস্তিদায়িক অবস্থায় আসবে। এরকম পরিস্থিতিতে মানুষের মৌলিক চাহিদার জায়গা ছিল তিনটি। প্রথমত দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের উপর ক্ষুব্ধতার একটা বড় কারণ ছিল নিয়ন্ত্রণহীন বাজার। কিন্তু নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বাজার তো নিয়ন্ত্রণ হয়নি, বরং বাজার আরও বেসামাল হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষ এখন দিশেহারা। এটি নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। সাধারণ মানুষের কাছে দ্বিতীয় চাহিদার বিষয় হল আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। মানুষ নিরাপদে চলাফেরা করতে চায়। নিরাপদে কর্মস্থলে যেতে চায় এবং স্বাভাবিক সুন্দর জীবনযাপন করতে চায়। কিন্তু গত তিন মাসে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। একদিকে যেমন চলছে মব জাস্টিস অন্যদিকে ছিনতাই-রাহাজানি, ডাকাতি উদ্বেগজনক ভাবে বেড়েছে। এ সমস্ত দমনের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারেনি বলে সাধারণ মানুষ মনে করে। এসময় পুলিশ বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তাও কাটিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি। পুলিশ এখন আগের মতো সক্রিয় নয়, বরং রুটিন কাজের মধ্যে তাঁরা নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রেখেছে। পুলিশের ভেঙে যাওয়া মনোবল এখনো পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফলে একটি নিস্ক্রিয় পুলিশ বাহিনী নিয়ে এই সরকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। এখন আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য এই সরকার পুরোপুরি যৌথ বাহিনী নির্ভর। কিন্তু এটা স্থায়ী বন্দোবস্ত হতে পারে না। তৃতীয়ত, এই সরকার যেন দাবীর চাপে দিশেহারা। দাবী আদায়ের লক্ষ্যে চাপ সৃষ্টি এবং বিভিন্ন দাবীতে রাস্তা ঘাট অবরোধ বা ঘেরাও ইত্যাদি কর্মসূচি এখন নিত্যকার দৃশ্য। কথায় কথায় শাহবাগ বা বিভিন্ন সড়কে জড়ো হয়ে শক্তি প্রদর্শনের সংস্কৃতি মানুষের পছন্দ করছে না। ফলে এই তিন মাসে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আশার প্রদীপ জ্বেলেছিল তা আস্তে আস্তে নিভে যেতে শুরু করেছে। ফলে সাধারণ মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করছে প্রকাশ্যে। আর এখানেই সাধারণ মানুষের আশা ভঙ্গের বেদনার গল্প শোনা যাচ্ছে কান পাতলেই। এখন প্রশ্ন হল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী সময়গুলোতে কী করবে? অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন-এটি নিয়ে এখন পর্যন্ত স্পষ্ট বক্তব্য নেই। নির্বাচন কবে নাগাদ হবে এবং কীভাবে হবে সেটি নিয়েও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোন ঘোষিত সুনিদিষ্ট রূপরেখা নেই। এরকম নানা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসলে কোন পথে যাবে? এই সরকার কী পথ হারিয়েছে?


Comments

User Avatar

Ali

2 months ago

Excellent

User Avatar

Dulal Hossain

2 months ago

তারা ৭১ এর পরাজয়ের প্রতিশোধে মেতে উঠেছে।

User Avatar

আশীষ চন্দ্র নন্দী

2 months ago

https://thecrimebd.net/news/79187/

Leave a Comment


Related Articles