Post Thumbnail

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ট্রাম্প’ কার্ড


মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ভূমিধ্বস বিজয় পেয়েছেন। বিভিন্ন জরিপে যেমনটি মনে করা হয়েছিল যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে, বাস্তবে তেমনটা ঘটেনি। একচেটিয়া বিজয়ের মাধ্যমে আগামী ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় বার হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১৩২ বছরের ইতিহাস ভেঙে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন তিনি। ট্রাম্পের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে যতটা উত্তেজনা ঠিক ততটুকু উত্তাপ, উত্তেজনা ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের বার্তা যখন বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছিল তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের উল্লাস ছিলো রীতিমতো দেখার। আওয়ামী লীগের অনেক কর্মীরাই মনে করেন যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের মধ্য দিয়ে ড. ইউনূসের প্রভাব এবং বাংলাদেশে মার্কিন প্রভাব কমে যাবে। বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত হবে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে কোনও প্রভাব ফেলবে না এমনটি বলছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব দাবি করেছেন যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের দলেও ড. ইউনূসের অনেক বন্ধু আছেন। এই কথা বলে তিনি বোঝাতে চাইলেন? এর ফলে অন্তর্বর্তী সরকার এবং আওয়ামী লীগ উভয়ই প্রমাণ করতে চাইলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা। আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দলের নেতাকর্মীরা পোস্ট করছেন। প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হবার সময় এই ছবিটি তোলা হয়। এটি দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কি প্রমাণ করতে চায়? বাইডেনের সঙ্গে তো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সেলফি ছিলো। কিন্তু তাতে কি দলটি মার্কিন রোষানল থেকে বাঁচতে পেরেছে? আসলে বাস্তবতা কি? বাংলাদেশের রাজনীতিতে কি ডোনাল্ড ট্রাম্প আসলেই ‘ট্রাম্প’ কার্ড হবেন নাকি এটি শুধুমাত্র হতাশা মুছে ফেলার জন্য এক ধরনের উচ্ছ্বাস? 

এ কথা অস্বীকার করার কোনও কারণ নেই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেট দলের সঙ্গে ড. ইউনূসের একটি সুসম্পর্ক আছে। বিশেষ করে প্রভাবশীল ক্লিনটন পরিবারের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সখ্যতার কথা সকলে অবহিত। এবার সেপ্টেম্বরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি জুলাই আন্দোলনের কয়েকজন শিক্ষার্থীকেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। যাঁদের মধ্যে তাঁর ‘বিশেষ সহকারী’কে তিনি আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবেও পরিচয় করিয়ে দেন বিশ্ব দরবারে। অনেকেই মনে করেন যে, বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের পিছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। ড. ইউনূস এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে কাজ করেছেন বলেও অনেকে বিশ্বাস করেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে এই ধারণা অনেকটাই বদ্ধমূল। আর এ কারণেই আওয়ামী লীগ কমলা হ্যারিস বা ডেমোক্রেটদের পরাজয়ে উল্লসিত। আওয়ামী লীগ মনে করছে, এর ফলে ড. ইউনূস এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপর মার্কিন যে সহমর্মিতা এবং সহযোগিতা তা অনেকটাই কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা কি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নির্বাচনের প্রভাব কতটা পরবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে? এই আলোচনার আগে একটি বিষয়ে সকলের মনোযোগ দেয়া উচিত, তা হল ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর প্রথম অভিনন্দন বার্তা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এরপর অভিনন্দন জানান ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী। শুধু তাই নয়, নরেন্দ্র মোদী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে টেলিফোনও করেছেন এবং তাঁকে বন্ধু হিসেবে অভিহিত করাচ্ছেন। ট্রাম্প কট্টর চীন বিরোধী। তাঁর মিশনে তিনি মোদীকে আরো ঘনিষ্ঠ ভাবে পেতে চাইবেন।

ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে কেন এত আগ্রহী এবং কেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নরেন্দ্র মোদী দ্রুত টেলিফোন করে অভিনন্দন জানালেন। এর ব্যাখ্যা এই অঞ্চলের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সঙ্গে কানাডার এক ধরনের টানাপোড়েন চলছে। এই টানাপোড়েনের ক্ষেত্রে ডেমোক্রেটদের একটা বড় প্রভাব আছে বলে অনেকে মনে করেন। বাংলাদেশ ইস্যুটিও ভারতের কাছে অন্তত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর ভারতের ‘সেভেন সিস্টার’ এখন রীতিমতো হুমকির মুখে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ন্যূনতম প্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। এই অবস্থায় ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করতে চায় ভারতীয় স্বার্থ সুরক্ষার জন্য। প্রথমত কানাডার সঙ্গে যে বিরোধ তৈরি হয়েছে, সেই বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে রিপাবলিকানরা ভারতকে যথেষ্ট সহযোগিতা করতে পারে বলে অনেক কূটনীতিক বিশ্লেষক মনে করছেন। জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈরী সম্পর্কের কথা কারো অজানা নয়। এটাই নরেন্দ্র মোদীর প্রধান মনোযোগের জায়গা হতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। তাছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রিপাবলিক পার্টি এই অঞ্চলে ভারত নীতিকে অনুসরণ করতে আগ্রহী। চীনের আধিপত্য ঠেকাতেই ট্রাম্প প্রশাসন এই কৌশলে বিশ্বাসী। অতীতেও দেখা গেছে যে রিপাবলিকানরা যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব বেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মাধ্যমে এই অঞ্চলে তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো দেখভাল করেছে। কাজেই স্বাভাবিক ভাবে বলা যায় যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত এই উপমহাদেশ ইস্যুতে নতুন করে হিসেব নিকেশ করবে। ফলে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিছুটা কোণঠাসা হলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। কারণ ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে প্রচণ্ড ভারত বিরোধী একটি মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই কারণেই ভারত তার নিজের স্বার্থের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে একটা দর কষাকষি করবেই। এছাড়াও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় একটা পরোক্ষ ভূমিকা রাখবে। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে একটা বার্তা ইতিমধ্যে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন ড. ইউনূসের প্রভাব কমে গেছে। বাস্তবতা যাই হোক না কেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কোনও পরিবর্তন না হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এটি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে বর্তমান সরকারের ব্যাপারে মানুষের যে ভয় এবং সহানুভূতি সেটা কিছুটা হলেও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যারা এখন ঘর থেকে বেরোতে পারছে না, সেই দলের নেতাকর্মীরা মনে করতে পারে যে এখন রাজপথে নামলে তাদের খুব একটা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এরকম পরিস্থিতিতে তারা রাজপথে বেরিয়ে আসার একটা সাহস এবং প্রেরণা পাবে। তাছাড়া আগে যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করত, ২০ জানুয়ারির পর সেটা আস্তে আস্তে কমে যেতে পারে। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, ক্ষমতার পালা বদলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক পররাষ্ট্র নীতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না। একজন প্রেসিডেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব কিছু বদলে দেন না। সবকিছু ধারাবাহিক ভাবে চলে। আর এই কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের খবরে যাঁরা উল্লাস প্রকাশ করছেন তাঁরা একটু অতি ‘কল্পনা বিলাসী’ বলেই মনে হয়। খুব বড় ধরনের পরিবর্তনের পথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো যাবে না। আর এই সমস্ত বাস্তবতার কারণেই অনেকে মনে করছেন যে আসলে এই নির্বাচনের ফলে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পরিবর্তন হবে না। উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগ যখন ২০১৪ সালে বিজয়ী হয়েছিল সে সময় ভারতের নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয় হয়, তখন বিএনপির অনেকে মিষ্টিমুখ করেছিল। তারা মনে করেছিল কংগ্রেসের পরাজয় আওয়ামী লীগের অবস্থানকে হয়তো কোণঠাসা করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে ফলাফল উল্টো হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছেন। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার পটপরিবর্তন বাংলাদেশের এই সরকারের প্রতি নেতিবাচক হবে, নাকি তারা আরও ঘনিষ্ঠ হবে সেটা সময়ই বলে দেবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারত একা কাউকে ক্ষমতায় বসাতে বা ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে না। এজন্য লাগে অভ্যন্তরীণ সমীকরণ।


Comments

User Avatar

Ali

2 months ago

You are right ✅️

Leave a Comment


Related Articles