Post Thumbnail

কর্মীরা কী নেতাদের ক্রীতদাস?


বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীর একজন সজ্জন মানুষ। সবসময় হাসি মুখে কথা বলেন। তাকে খুব একটা উত্তেজিত দেখা যায় না সচরাচর। গত পনেরো বছর তিনি দল সামলেছেন, নানা রকম ঝঞ্চা ও বিক্ষুব্ধতার মধ্য দিয়ে কঠিন সময়ে তিনি দলের হাল ধরেছিলেন। দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া যখন কারাগারে এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক জিয়া বিদেশে তখন এক সংকটাপন্ন অবস্থায় দলকে আগলে রাখেন। তার নেতৃত্ব ও বিচক্ষণতার জন্যই বিএনপি এখন পর্যন্ত দল হিসেবে শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে। কিন্তু গত ৩ নভেম্বর এই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মেজাজ হারালেন। জিয়াউর রহমানের করব জিয়ারত করতে গিয়ে তিনি এক কর্মীকে চড় মেরে বসলেন। ঐ দিন বিএনপির চট্টগ্রামের নেতা ড. শাহাদাত চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। তার শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানের পর জিয়ার করবে শ্রদ্ধা জানাতে যায় বিএনপি নেতাকর্মীরা। এখানেই এই ঘটনা। মুর্হূতে মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ এবং মূল ধারা গণমাধ্যমে এই চড় মারা দৃশ্যটি ভাইরাল হয়। 

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মেজাজ হারিয়েছেন এটা বড় কথা নয়। কিন্তু এর মাধ্যমে একটি বিষয় প্রমাণিত হয়েছে যে, আমাদের রাজনৈতিক দলে কর্মীরা নেতাদের কাছে কতটা অসহায়, কতটা তুচ্ছ এবং মর্যাদাহীন। অথচ এই কর্মীরা ছাড়া নেতারা চলতে পারেন না। কর্মীদের কারণে রাজনৈতিক দলগুলো টিকে আছে। মির্জা ফখরুল আলমগীর যে এই কাজটি একমাত্র করেছেন তা নয়। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঠিক একই রকম একটি ঘটনা ঘটিয়ে ছিলেন কক্সবাজারে। বিভিন্ন সময়ে তিনি কর্মীদের ধমক দিতেন এবং শাসাতেন, কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করতেন। তিনি এমন ভাষায় কর্মীদের সাথে কথা বলতেন যেন তারা চাকর-বাকর কিংবা ক্রীতদাস। রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে এমন নিম্নমানের আচরণ নেতারা হরহামশোই করে থাকেন। অথচ একজন রাজনৈতিক কর্মীই দলের প্রাণ। কর্মীরাই একটি দলকে বাঁচিয়ে রাখেন। 

আমরা যদি একটি রাজনৈতিক দলের পরিকাঠামো বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখবো কর্মীরাই আগামী দিনের নেতা। আসলে আদর্শিক সহযোগিতার নেতাকর্মী বলে রাজনৈতিক দলের কিছু নেই, আছে সহযোদ্ধা। কর্মীদের মধ্য থেকেই নেতা র্নিবাচিত হন। একজন কর্মী এবং নেতা একই আদর্শে উজ্জীবিত। তারা আসলে সহকর্মী। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে এই প্রথাটি এখন প্রায় উঠে গেছে। নেতারা নিজেদের মনে করে রাজা-মহারাজ আর কর্মীদের মনে করে সেবাদাস। কর্মীদের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে নেতাদের সন্তুষ্ট অর্জন। নেতারা কি পেলে খুশি হবেন, নেতারা তাদের কর্মীদের দিকে নজর দিবেন, সেই চিন্তায় যেন সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে কর্মীরা। আদর্শ চর্চা চুলোই গেছে বহু আগেই। 

বাংলাদেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাসায় হাট-বাজার হয় না। কর্মীরা তাদের মাছ, লাউ, এমন কি লেবু পর্যন্ত কিনে দেন। কর্মীরা নেতাদের পা ধুঁয়ে দেন, জুতা পরিয়ে দেন। অনেক সময় নেতা যেন বৃষ্টিতে ভিজে না যান সেজন্য নেতার সামনে ছাতা ধরেন। নেতাদেরকে খুশি করতে কি করেন না কর্মীরা? কিন্তু কেন এটি হবে? একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের কর্মীরা কেন অসম্মানিত হবেন? কেন তাদের প্রতি এই ধরণের অবজ্ঞাসূচক আচরণ করা হবে- সেই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা এখন অন্তত জরুরী। বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে আমরা প্রায় হাহাকার শুনি। গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের আর্তনাদ কম নয়। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত যে দলের ভেতর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা আমরা সেটা প্রায়ই ভুলে যাই। বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দলেই কোন গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। বরং রাজনৈতিক দলগুলো দিন দিন স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠছে। নেতাদের বিরুদ্ধে তো কোনো কথা বলাই যাবে না। বরং নেতারা কিসে খুশি থাকবেন এটি নিশ্চিত করতে হবে কর্মীদেরকে। কিন্তু এক বার ভাবেন তো যদি এই কর্মীরা না থাকে, কর্মীরা যদি নেতাদের ডাকে কর্মসূচিতে না আসে, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর কি হবে। নেতাদেরই বা কি হবে? 

আওয়ামী লীগ গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা সবাই এখন পলাতক। পলাতক নেতারা বিদেশ বসে আরাম-আয়েশ জীবন যাপন করছেন। নিরাপদ দূরত্বে থেকে তারা বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য বা বিবৃতি দিচ্ছেন। কর্মীদের আন্দোলন করার পরামর্শ দিচ্ছেন কেউ কেউ। অনেক পলাতক নেতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভে এসে বুলি আওড়াচ্ছেন। কেউ কেউ আবার বিভিন্ন বিদেশি চ্যানেলের টকশোতে গাল ভরা বক্তৃতা  দিচ্ছেন। অথচ তাদের কোন অনুশোচনা নেই। অপকর্মের দায় স্বীকার নেই। তারা কর্মীদের কথা একবারও ভাবছেন না। কর্মীরা কি করছে, কি অবস্থায় আছে, তারা কতটুকু অত্যাচারিত নিপীড়িত হচ্ছে সেই ভাবনা নেই নেতাদের। নেতারা তাদের পরিজনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে লুণ্ঠিত অর্থে বেশ আছেন। এটা কতটুকু যৌক্তিক, কতটুকু গ্রহণযোগ্য, কতটা নৈতিক?

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখ যায় কর্মীদের সাথে এ ধরনের আচরণের রেওয়াজ অতীতে ছিলো না। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে দেখবো বঙ্গবন্ধু তার নেতা হোসেন শহীদ সোহাওয়ার্দী সঙ্গে রীতিমতো বাহাস করেছেন। হোসেন শহীদ সোহাওয়ার্দী বলেছেন, ‘ইউ আর নো বডি’। তখন তার প্রতিবাদ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু সেই রকম কর্মীরা এখন কোথায়? 

কর্মীদের এই অবজ্ঞা, অবহেলা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা জন্য শুধু যে নেতা দায়ী এমনটা নয়। কর্মীরাও এর জন্য কম দায়ী নয়। এটি একটি রাজনৈতিক ব্যাধি। অনেকেই বিভিন্ন বড় বড় রাজনৈতিক দল গুলোতে যোগদান করেন কিছু পাওয়ার আশায়, নানা রকম সুযোগ সুবিধা, নানা রকম ব্যবসা বাণিজ্য এবং এটা সেটা করে রাতারাতি ধনী হওয়ার জন্য। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এদের না আছে আদর্শিক চর্চা, না আছে রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি বিশ্বাস। এই সমস্ত তথাকথিত কর্মীরা সব সময় চিন্তা করেন কিভাবে নেতার আনুকূল্য করা যাবে। চাটুকারিতা করে নেতাকে খুশি করে বড় পদ পাওয়া যাবে, এমপি হওয়া যাবে কিংবা কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়া যাবে। তাহলেই তাদের ভবিষৎ উজ্জ্বল হবে। তাদের আয় উপার্জন তরতর করে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই ধারার কারণে কর্মীরা এখন বিবেক বুদ্ধিহীন এবং ব্যক্তিত্বহীন হয়ে গেছে। তারা শুধু মাত্র বৈষিয়ক প্রাপ্তির আশায় সবকিছু বিলিয়ে দেন। আর এ কারণেই সব রাজনৈতিক দলে এখন ঢুকছে অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিডরা, যাদের মধ্যে কোন আদর্শ চর্চা নেই, যারা রাজনীতিতে এসেছেন শুধুমাত্র কিছু পাওয়ার আশায়। এই সমস্ত কর্মীরাই রাজনৈতিক দলের সর্বনাশ করছে। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তখন ঐ সমস্ত কর্মীরা নেতাদের কাঁধে চড়ে তরতর করে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বাগিয়ে নেন। নেতার চারপাশে তারা ঘুরঘুর করেন এবং নেতাকে খুশি করার জন্য তাদের ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মান সবকিছু বিকিয়ে দেন। মনোনয়ন বা পদ পেলে তারা শুরু করেন লুণ্ঠন এবং দুর্নীতি। এর ফলে সর্বনাশ ঘটে দলটির। এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া উচিত। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ঘটনা শুধুমাত্র একটি শিক্ষা। সকল রাজনৈতিক কর্মী যদি আদর্শবান থাকেন, তার যদি আত্মসম্মানবোধ থাকে তাহলে তিনি নেতার প্রতি অনুগত থাকবেন বটে কিন্তু নেতার ভুল কাজের সমালোচনাও করবেন। নেতার সাথে তার সম্পর্ক হবে আদর্শিক, মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক। মোসাহেবী আর চাটুকারিতা করে যদি কর্মীরা কিছু পেতে চান তাহলে রাজনীতি আর রাজনীতি থাকে না। বাংলাদেশে এখন সেটাই হচ্ছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ঘটনা তার একটি উদাহরণ মাত্র।


Comments

User Avatar

শাহানা পারভীন

2 months ago

বাংলাদেশ ছুটছে ন্যায় নীতি আদর্শ বিহীন যেন এক পাগলা ঘোড়া ।অথচ একটি মানুষের চলার পথে তার আদর্শ ন্যায় নীতি হচ্ছে তার চলার পথের পাথেয় , তেমনি একজন রাজনীতিবিদের আদর্শ প্রভাবিত করে তার কর্মীকে যা জাতি গঠনে সহায়ক। চমৎকার বিস্তিত্ব সুলেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ ।

Leave a Comment


Related Articles