Post Thumbnail

প্রথম আলো: জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ


দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয় দৈনিক প্রথম আলোর ২৬ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। ২৬ বছরে এই পত্রিকাটি কেবল একটি সংবাদপত্র থাকেনি, একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য, আস্থাভাজন সংবাদপত্র প্রথম আলো। স্বাধীনতাত্তোর দেশে সবচেয়ে সফলতম সংবাদপত্র প্রথম আলো- এ নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু ২৬ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এসে প্রথম আলো যেন এক উভয় সঙ্কটে পড়েছে। এক জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে প্রথম আলোকে তাঁর ২৬ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে প্রথম আলো কি সত্যি নিরপেক্ষ নাকি কোন এজেন্ডা বাস্তবায়নের মিশনে দায়িত্ব প্রাপ্ত?

প্রথম আলো ২৬ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মূল স্লোগান হলো ‘জেগেছে বাংলাদেশ’। প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পত্রিকাটির সম্পাদক তাঁর সম্পাদকীয় কলামে লিখেছেন, ‘জেগেছে বাংলাদেশ, জয়ী হবে বাংলাদেশ’। তিনি দাবি করেছেন যে, ‘একবছর আগে এদিনে এরকম মুক্ত পরিবেশে আমরা ভাবতে পারিনি। যদিও প্রথম আলো সবসময় মুক্তির স্বপ্নের কথা বলেছে, আশার কথা বলেছে অবিরত।’ তিনি জুলাই বিপ্লবের পক্ষে তাঁর অবস্থান তাঁর সম্পাদকীয়তে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কী অভাবনীয় বিদ্রোহ, ছাত্র-জনতার এক অভ্যুত্থান ঘটে গেল বাংলাদেশে। ছাত্ররা ডাক দিলো ঊনসত্তরের ড. শামসুজ্জোহার কথা স্মরণ করে রংপুরে আবু সাঈদ গেলেন প্রতিরোধের মিছিলে। তাঁদের মুখে স্লোগান ‘বুকের ভিতরে অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।’ এ কথা অস্বীকার করার কোনও কারণ নেই যে, জুলাই বিপ্লবে প্রথম আলোর ভূমিকা ছিলো অন্তত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ‘প্রথম আলো’ সবসময় পক্ষে ছিলো। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পক্ষে প্রথম আলোর অবস্থান বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপে ফেলেছিল সন্দেহ নেই। শুধু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান নিয়েই নয়, গত এক যুগ প্রথম আলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম আলোর সুস্পষ্ট একটি অবস্থান ছিলো ধারাবাহিক ভাবে। প্রথম আলোর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের বিরোধ শুরু হয় ২০০৭ সালের এক এগারোর সময় থেকে। অভিযোগ আছে প্রথম আলো এক এগারোর সময় বিরাজনীতিকরণ তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা। সেই সময় পত্রিকাটি ‘দুই নেত্রীকে সরে যেতেই হবে’- এই শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান নিজেই এই সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। ওই সময় প্রথম আলোতে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে অবিরত নানা রকম দুর্নীতির কথা, দুর্নীতির তথ্যাদি প্রকাশিত হতে শুরু করে। বিশেষত বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির তথ্য সম্বলিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো এক এগারোর পথকে প্রশস্ত করেছিল বলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলই অভিযোগ করে। সেই সময় ২০০৬/০৭ সালে প্রথম আলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মোসাদ্দেক আলী ফালু, হারিস চৌধুরী, তারেক জিয়া সহ বিভিন্ন বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে লাগাতার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করেছিল প্রথম আলো। এগুলো কতটা বাস্তব তা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু এসব প্রতিবেদন সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করেছে। প্রথম আলো এখন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলের সবচেয়ে বড় সমালোচক প্রথম আলো। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রথম আলোর সাথে সরকারের দূরত্ব আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। এক সময় প্রথম আলোর প্রবেশ গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। প্রথম আলোকে সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত করা হয়। অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেন প্রথম আলোকে বিজ্ঞাপন না দেয়- সরকারের পক্ষ থেকে এ রকম মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল বলেও কেউ কেউ অভিযোগ করে থাকেন।

প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের ঘটনার পর সরকার এবং প্রথম আলো যেন প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়৷ এই বৈরী সময় প্রথম আলো সাহসিকতার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশন করেছে সন্দেহ নেই। প্রথম আলোর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো বিশ্বাসযোগ্যতা। প্রথম আলোর প্রতিবেদন সত্য মিথ্যা যাই হোক না কেন সাধারণ মানুষের কাছে প্রথম আলোর আলাদা একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। আর এ কারণেই প্রথম আলোকে সরকার বিরোধী একটি সংবাদপত্র হিসাবে বিবেচনা করা হত। যদিও প্রথম আলো মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি বিষয় বরাবরই তাদের অভিন্ন এবং সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করে রেখেছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের পর থেকে এই পত্রিকাটির সঙ্গে সরকারের দূরত্ব অনেক বেশি বাড়তে থাকে এবং দুজন দুজনের ‘শক্র’ হিসাবে আবির্ভূত হয়। ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন বা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সহ সব আন্দোলনে প্রথম আলো ছিলো অন্তত সোচ্চার।

আওয়ামী লীগ মনে করতেই পারে সরকার পতনের ক্ষেত্রে প্রথম আলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এবং বিশেষ করে জনমত তৈরিতে প্রথম আলোর ভূমিকার কথা আওয়ামী লীগ অন্তত ভুলবে না। তাই আমরা সাধারণ পাঠকরা মনে করেছিলাম আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হয়তো প্রথম আলোর জন্য একটা স্বস্তিকর সময় আসবে বিশেষ করে নতুন সরকারের উপদেষ্টারা যখন অধিকাংশই প্রথম আলোর কলাম লেখক, তখন প্রথম আলোই সরকারের একটি মুখপাত্র হিসেবে কাজ করবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সাথে প্রথম আলোর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পর একটিমাত্র বাংলা দৈনিকে পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেটি হলো প্রথম আলো। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান সেই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন। দুই দিন ধরে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়।

উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যদের মধ্যে ড. আসিফ নজরুল, ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আলী ইমাম মজুমদার, ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, এম. সাখাওয়াত হোসেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সহ অনেকেই প্রথম আলোর নিয়মিত কলাম লেখক। কাজেই প্রথম আলোর একটা আনন্দময় উপলক্ষ্য ছিলো আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং নতুন সরকার গঠন। কিন্তু এর মধ্যেই কোথায় যেন ঘটল কোন সর্বনাশ। প্রথম আলোর বিরুদ্ধে এখন বিভিন্ন গোষ্ঠী অত্যন্ত সোচ্চার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রথম আলো বয়কটের ডাক দেয়া হয়েছে। প্রথম আলো ভারতের এজেন্ট, প্রথম আলো ইসলামের শত্রু এবং প্রথম আলো ভারতের হয়ে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করতে চায়- এমন  কথাগুলো এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন ভাইরাল। বিশেষ করে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগ করা হয়েছে বেশ জোরেশোরে। এ সংক্রান্ত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এটি নিয়ে হইচই চলছে। তাছাড়া প্রথম আলোর একজন প্রভাবশালী উচ্চপদস্থ কর্মীর বিরুদ্ধে কোরআন অবমাননার অভিযোগ এনে আইনগত নোটিস পাঠানো হয়েছে। প্রথম আলো বর্জনের ডাক দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কিছু অ্যাকটিভিস্ট। সবকিছু মিলিয়ে প্রথম আলো এখন পুলিশ প্রহরায় দিনযাপন করছে। 

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রথম আলোর অনেক জায়গায় প্রবেশাধিকার ছিলো না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সংসদে কথা বলতেন। তিনি বলেছেন যে আমি প্রথম আলো পড়ি না। কাজেই আওয়ামী লীগ থেকে মুক্ত হয়ে যখন প্রথম আলো ডাঙায় উঠল এখন বাঘের ভয়ে প্রথম আলো আতঙ্কের দিন কাটাচ্ছে। যারা এখন প্রথম আলোকে হুমকি দিচ্ছে তারা আওয়ামী লীগের মতো খুব নমনীয় সমালোচক না। গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতাও তাদের নেই। সমালোচনা করেই তারা ক্ষান্ত হবে না। তারা প্রতিশোধ চায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ভাষায় প্রথম আলোকে আক্রমণের কথা বলা হয়েছে, তা রীতিমতো আতঙ্কের। সরকার অবশ্য এখন পুলিশ পাহারা দিয়ে প্রথম আলোকে রেখেছে৷ প্রথম আলো এই পরিস্থিতিগুলো নিয়ে এখনও মৌনব্রত অবলম্বন করছে। কিন্তু যাদের টার্গেট প্রথম আলো হয়েছে তাঁরা কি প্রথম আলোকে ছাড়বে? প্রথম আলো একদিকে যেমন আওয়ামী লীগের শক্রে পরিণত হয়েছে, এজন্য তারা জল থেকে ডাঙায় উঠে এসেছে। আর এখন ডাঙায় তাদেরকে আক্রমণ করছে ভারতবিরোধী এবং ইসলামপন্থি একটি গোষ্ঠী। এই অবস্থা থেকে প্রথম আলো শুধু পাঠকের ভালোবাসায় কতদূর এগোতে পারবে সেটি দেখার বিষয়। তারপরও একটি কথা বলা প্রয়োজন প্রথম আলো পাঠকের ভালোবাসায় ধন্য একটি পত্রিকা। বাংলাদেশের মানুষ যেমন দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন পছন্দ করে না তেমনি উগ্র ধর্মান্ধতাকেও পছন্দ করে না। প্রথম আলো এই দুটি বিষয়কেই তার সম্পাদকীয় নীতিতে চমৎকার ভাবে যুক্ত করেছে। আর এ কারণেই প্রথম আলো এখন পর্যন্ত প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হচ্ছে। সামনে প্রথম আলোর জন্য কোন সুসময় নেই। বরং আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে বলেই ধারণা করা যায়।


Comments

User Avatar

চমৎকার বিশ্লেষণ

2 months ago

বোরহান কবির প্রথম আলোর সম্পর্কে যা কিছু লিখেছেন তা সময়ের যথার্থ বিশ্লেষণ বলে মনে করি। আমি তার সাথে সহমত পোষণ করে প্রথম আলোর উত্তর উত্তর সমৃদ্ধি কামনা করছি

User Avatar

Bablu Rahman

2 months ago

প্রথম আলো-র আগে ও এখনকার অবস্থা সম্পর্কে সৈয়দ বোরহান কবীর যা লিখেছেন, তার সাথে সম্পূর্ণ সহমত জানাচ্ছি। নির্মোহ এই পর্যবেক্ষণের জন্য সাধুবাদ। তবে প্রথম আলো এখনকার 'গলা ধাক্কা' থেকে কোনো শিক্ষা নিতে পারবে কি?

User Avatar

হামিদ মোহাম্মদ জসিম

2 months ago

চমৎকার বিশ্লেষণ। তবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যতটা সোচ্চার ছিল প্রথম আলো, ততটাই নমনীয় বর্তমান সরকারের পক্ষে। অনেক কিছু দেখেও না দেখার ভান করছে। যা প্রথম আলো"র ভাবমূর্তির সঙ্গে একেবারেই বেমানান। এরপরও মৌলবাদী গোষ্ঠীর রোষানলে পড়তে হচ্ছে, এটা অভাবনীয়। ইহাকেই স্বাধীনতা বলে!

User Avatar

M.U.Ahmed

2 months ago

Thanks for Sharing towards All Reader about The Role of Prothom Alo in this Moment. One Of the Influencial YouTuber P. Bhattacharya from France from Very Long Time Demanding P.Alo is 100% DALAL of India including the 'Daily Star' Still Now & Upto 26th Anniversary of P.Alo ,& Authority of that News Paper are Silent & have Not Clearify and Shown Rejoinder about Various Corner's Propogandas! Analyses about Prothom Alo's Conditions-Roles etc. By Eminent Columnist Mr. B. Kabir in the LAST 4/5 lines Forecasted Proves that it is Not A Good Omen!!

User Avatar

M.U.Ahmed

2 months ago

Thanks for Sharing towards All Reader about The Role of Prothom Alo in this Moment. One Of the Influencial YouTuber P. Bhattacharya from France from Very Long Time Demanding P.Alo is 100% DALAL of India including the 'Daily Star' Still Now & Upto 26th Anniversary of P.Alo ,& Authority of that News Paper are Silent & have Not Clearify and Shown Rejoinder about Various Corner's Propogandas! Analyses about Prothom Alo's Conditions-Roles etc. By Eminent Columnist Mr. B. Kabir in the LAST 4/5 lines Forecasted Proves that it is Not A Good Omen!!

Leave a Comment


Related Articles