Post Thumbnail

এক টুকরো শান্তির দাম কত?


পৃথিবীতে সবচেয়ে আরাধ্য বস্তুর নাম কি? এর উত্তরে অনেকে হয়তো অনেক কিছু বলবেন। কারো মতে, অর্থ-সম্পদ হলো মানুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। বিপুল সম্পদ হলেই সবকিছু পাওয়া যায় আপনাআপনি। বস্তুত ভুল। অর্থ-বিত্ত আপনাকে সবকিছু দিতে পারে, পারে না শুধু শান্তি দিতে। এই পৃথিবীতে এখন ‘শান্তি’ যেন সবচেয়ে দামী। সারা বিশ্বেই যেন শান্তির জন্য হাহাকার। বাংলাদেশে শান্তি এখন আরো দুর্লভ।

৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সবাই আশা করেছিলেন দেশের শান্তি আসবে, একটি শান্তিপূর্ণ সৌহার্দ্যের জীবন আমরা উপভোগ করব। অতীতের বঞ্চনা, বৈষম্য, অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, লুটপাটের অবস্থা থেকে মানুষ একটি স্বাভাবিক শান্তির জীবনে ফিরে আসবে। আমরা এ দেশের মানুষরা খুব বেশী কিছু চাইনা। আমরা দু বেলা দু মুঠো ভাত পেটপুরে খেতে চাই। রাতে শান্তিতে ঘুমাতে চাই। নিরাপদে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে চাই। এই তিনটি আমাদের মৌলিক চাহিদা। এর বেশি চাহিদা খুব কম মানুষেরই আছে৷ এ দেশে দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্তের সংখ্যা খুব কম। যারা টাকার নেশায় মত্ত হয়ে যায়, বিদেশে অর্থপাচার করে শত শত বাড়িঘর করেও তাঁদের মনের স্বাদ মেটে না, তেমন মানুষ কজন? তাঁরাই শান্তি বিনষ্ট করে। এরাই সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে। ৫ আগস্টের পর বলা হলো এটি নতুন বাংলাদেশ। তাহলে সেই নতুন বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ হবে এটিই তো স্বাভাবিক। সেই শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ কোথায়?

বাজারে এখন জিনিসপত্রের দাম নিয়ে হাহাকার। মানুষের অস্বস্তি এবং আর্তনাদ এখন গর্জনে রূপান্তরিত হচ্ছে। বাজারে গিয়ে মানুষ চিৎকার চেঁচামেচি করছে। বিভিন্ন পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবস্থা অন্তত নাজুক। যাঁরা মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডিতে থাকেন তারা সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হন না। এ যেন এক নতুন গাজা কিংবা সোমালিয়া, যেখানে সবসময় ঘাতকের ভয়ে মানুষ দরজা-জানালা বন্ধ করে এক নির্ঘুম রাত্রি যাপন করে। একটি ভোর হওয়া মানে একদিনের জীবন লাভ। মানুষ এরকম একটি দম বন্ধ অবস্থা কখনোই চায়নি। কিন্তু বাস্তবতা হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মানুষকে এক ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে নিয়ে গেছে। শুধু মোহাম্মদপুর, ধানমণ্ডি নয়, পুরো ঢাকা শহরেই এক ধরনের আতঙ্ক এবং নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি, সেটা দেখার কেউ নেই। সন্ধ্যার পর রাজধানীর সমস্ত রাস্তাঘাট, অলিগলি দখল করে নেয় ছিনতাইকারীরা। তাঁরাই যেন তখন সড়কে রাজা হয়, তাদেরকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কেউ নেই। পুলিশ এখন থেকেও নেই। পুলিশ কী করছে বা পুলিশের ভূমিকা কী? এ নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। পুলিশ নিজেদেরকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। কিছু পুলিশ সদস্যের মৃত্যু এবং এখন পুলিশের অস্ত্রশস্ত্র এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের প্রবল সংকট তাদেরকে সবকিছু থেকে নির্লিপ্ত করে রেখেছে। তাঁদের মধ্যে প্রচন্ড হতাশা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব। সরকারের পক্ষ থেকেও স্বীকার করা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের মনোবল ভেঙ্গে গেছে। এই মনোবল চাঙ্গা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু পুলিশের মনোবল কবে চাঙ্গা হবে সেটি এখন একটি বড় প্রশ্ন। সেনাবাহিনী আছে বলে তাও একটু ভরসা। এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যতটুকু যৎসামান্য টিকে আছে তা সেনাবাহিনীর বদৌলতে। কিন্তু এভাবে সেনাবাহিনী কতদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে সেটিও এখন একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে সামনে এসেছে। 

দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য বলে কিছু নেই। গত তিন মাসে সবাই হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন। বড় বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ীরা নতুন কোন বিনিয়োগে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। তাঁরা তামাশা দেখছেন। অনিশ্চয়তার চাদরে ঢাকা পুরো অর্থনৈতিক ক্ষেত্র। সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের কথা বলা হচ্ছে বটে, তাতে আশ্বস্ত হচ্ছেন না কেউই। বরং কিছু কিছু বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা, তাঁদের নানা রকম আৰ্থিক বিষয়ে তদন্ত ব্যবসা-বাণিজ্যকে করেছে স্থবির। শুধু বড় ব্যবসায়ীরাই নয়, ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসায়ীরাও এখন নানা রকম অনিশ্চয়তায়। ৫ আগস্টের পর দখল বাণিজ্য শুরু হয়েছিল। বিভিন্ন হাট-বাজার দখল, ব্যবসা কেন্দ্র দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। ফলে অর্থনীতিকে গ্রাস করেছে ভয়। আতঙ্ক গ্রাস করছে অর্থনীতিকে।

আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ডের একটি হলো গার্মেন্টস শিল্প। গার্মেন্টস খাতে চলছে ভয়াবহ অশান্তি। থেমে থেমে কদিন পর বেতন ভাতার দাবিতে গার্মেন্টস কর্মীদের অসন্তোষ হচ্ছে, ভাঙচুর হচ্ছে, হচ্ছে নানা রকম বিশৃঙ্খল ঘটনা। কদিন আগেই মিরপুরে বেতনের দাবিতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল প্রায়। এ রকম ঘটনা সামনে যে আর ঘটবে না তার নিশ্চয়তা দিতে পারে না কেউই। রেমিট্যান্স একমাত্র সুখবর। সেই রেমিট্যান্স ক্ষেত্রেও অশনি সংকেত শোনা যাচ্ছে। রেমিট্যান্স যোদ্ধারা আল্টিমেটাম দিয়েছে। শুধু রেমিট্যান্স যোদ্ধা না, এখন বাংলাদেশে দাবি দাওয়ার মহোৎসব চলছে। যে যেখানে পারছে দাবিদাওয়া উচ্চারণ করে রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে। যে যেভাবে পারছে বিভিন্ন রকম দাবিদাওয়া নিয়ে রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। রাস্তা বন্ধ করে জনগণকে জিম্মি করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দাবী আদায়ের কৌশল এখন ব্যাপক জনপ্রিয়। ঢাকা শহরে আপনি বেরোলে আপনি জানবেন না যে কখন আপনি বিপদে পড়বেন। রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে এবং আপনার পুরো দিন পথে বসেই কাটাতে হবে। এরকম একটা অনিশ্চয়তা ভরা পরিস্থিতিতে এক শক্তি প্রয়োগের নীতি যেন দেশে কায়েম হয়েছে। জোর যার আছে তাঁরই সবকিছু- এরকম একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে। শক্তি প্রয়োগের এই নীতিতে রাজনৈতিক দলের কার্যালয়গুলো ভাঙচুর হয়েছে। জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করেছেন। সেখানেও দেখা দিয়েছিল অস্থিরতা। রাষ্ট্রপতি টিকে গেছেন বটে। তবে এটি নিয়ে নাটক এখনো শেষ হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের দাবিতে ছাত্ররা ঘেরাও করেছে। একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এ রকম জবরদখলের প্রবণতা যদি চলতে থাকে তাহলে তা দেশকে একটি ভয়াবহ অবস্থার দিকে নিয়ে যাবে। প্রশ্ন উঠেছে, আমরা কি সেই পথেই যাচ্ছি? একদল শিক্ষার্থী গিয়ে বলেছে, তাঁরা পরীক্ষা দিতে পারবে না। পরীক্ষা বাতিল হয়ে গেছে। আরেক দল শিক্ষার্থী বলেছে সকলকে পাশ করাতে হবে। তাঁরা শিক্ষা ভবন ঘেরাও করেছে। পাঁচশ ছয়শ লোক জড়ো হয়ে যদি কোনও প্রতিষ্ঠানে গিয়ে চাপ দেয়া হয় দাবি আদায়ের জন্য, হুলস্থুল করা হয়, ভয় ভীতি, হুমকি দেখানো হয় তাহলেই কেল্লাফতে। সবকিছু সমাধান হয়ে যাবে। আইনের শাসন এখন কেতাবের গরু। এই সমস্ত ঘটনার বিচার করার কোনও ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেই।

প্রশ্ন উঠেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগ্রাধিকার কী? এই সরকার কিছু সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করেছে। কমিশন গুলো কাজ করছে। কিন্তু একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য দ্রুত কতগুলো মৌলিক বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ তৈরি করা- এই তিনটি কাজের একটিও হচ্ছে না, বরং প্রতিশোধস্পৃহা এবং প্রতিশোধের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা বা দমন করার দিকেই সবার মনোযোগ বেশি। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আওয়ামী লীগ সরকার নিয়ে অনেকের ক্ষোভ বিক্ষোভ আছে, থাকবে সেটি করার জন্য ইতিমধ্যে একাধিক মামলা হয়েছে৷ আইন এবং বিচার তাঁর নিজস্ব গতিতে চলবে। আইন এবং বিচারিক পথেই এটির মীমাংসা হতে পারে। কিন্তু তাই বলে কথায় কথায় কাউকে হুমকি দেয়া, কথায় কথায় কাউকে বাদ দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ এবং বলপ্রয়োগের নীতি কখনোই শুভ লক্ষণ নয়। আমরা একটা শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলাম। বাজারে যেমন জিনিসপত্রের দাম মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে, নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে তেমনি এখন ‘শান্তি’ যেন এক দুষ্প্রাপ্য বস্তু। এখন আমাদের সবচেয়ে দরকার এক টুকরো শান্তি। এক টুকরো শান্তির মূল্য কত- সেটিই এখন মানুষের প্রধান প্রশ্ন। মানুষ অনেক রক্ত দিয়ে একটি সরকারকে বিদায় দিয়েছে। এখন এক টুকরো শান্তির জন্য মানুষ কি আবার রক্ত দিবে?

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


Comments

User Avatar

শাহানা পারভীন

2 months ago

খুব বেশি কিছু চায় না এ জাতি , এক মুঠো ভাত এক চিমটি নুন , নিরাপত্তায় রাস্তাঘাটে চলা ফেরা ,নিশ্চিতে রাতের ঘুম , সব সামলিয়ে এক রত্তি শান্তি চায় বাঙালী ।আপনার লেখা মেহনতি মানুষের হাতিয়ার হোক , অসহায়দের আলোক বাতি হোক , শান্তির কলম চলুক প্রতিদিন প্রতিক্ষণ প্রতিজন ॥

User Avatar

অমিত কুমার দে

2 months ago

আমাদের কথা-বার্তা, আচার-আচরণে সংযত না হলে, জিহ্বার ব্যবহার না করতে জানলে "শান্তি" খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পরম করুণাময় মহান সৃষ্টিকর্তা মানব দেহে ২০৬ খানা হাড়ের কাঠামো দিয়েছেন ; কিন্তু তিনি জিহ্বায় কোন হাড় দেন নি; বোধ করি, সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে, আমরা যেন জিহ্বা দিয়ে শক্ত কথা, তিক্ত কথা, কটূ কথা না বলি! কিন্তু, এর উল্টো ঘটছে, সুতরাং শান্তি কীভাবে আসবে! আমরা সবাই যেন সবজান্তা, সর্ববিষয়ক বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছি। ধন্যবাদ আপনাকে।

Leave a Comment


Related Articles