সেই আওয়ামী লীগ, এই আওয়ামী লীগ
আজ ৩ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালে এই দিনে জাতীয় চার নেতাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট জাতি পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতায় জেলহত্যা ঘটনা। আওয়ামী লীগকে তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাজনৈতিক শক্তিকে নেতৃত্ব শূন্য করা জন্য জাতীয় এই চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দুর্বিষহ এক অনিশ্চিতার মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক সময় অতিবাহিত করেছিল। অস্তিত্বের এক দারুণ সংকটের সেই সময়ের সঙ্গে আজকের বাস্তবতা তুলনা করা যেতেই পারে। সেই সময় আওয়ামী লীগ কেমন ছিল, আজকের আওয়ামী লীগ কেমন তারও একটি তুলনামুলক আলোচনা হতে পারে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। দলের শীর্ষ নেতাদের নানা ভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, মামলা দেয়া হয়েছিল। আর ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে যারা বঙ্গবন্ধুর পর আওয়ামী লীগের হাল ধরতে পারতেন, আওয়ামী লীগকে এগিয়ে নিতে পারতেন তাদেরকেও হত্যা করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার এক সর্বগ্রাসী তৎপরতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল পঁচাত্তরেরে ১৫ আগস্টের পর থেকে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। ৫ আগস্ট তীব্র গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা দিল্লি চলে যান। তারপর আওয়ামী লীগের এক হতশ্রী ছিন্নভিন্ন অবস্থা জাতি প্রত্যক্ষ করছে। তবে পঁচাত্তরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বর্তমানের আওয়ামী লীগের মৌলিক র্পাথক্য সকলের কাছে দৃশ্যমান। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আওয়ামী লীগের র্শীষ স্থানীয় অনেক নেতাই পালিয়ে যাননি। বরং তাঁরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছিলেন। তাঁরা বুঝার চেষ্টা করেছিলেন যে কি হচ্ছে। অনেকেই খুনি মোশতাকের সাথে হাত মিলিছিলেন। বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর পা রেখে তাঁরা বঙ্গভবনে গিয়ে শপথ গ্রহণও করেছিলেন। সেই সময় খুনি মোশতাকের সরকার গঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের দিয়েই। শুধু মাত্র যারা খুনি মোশতাকের প্রতি আনুগত্য দেখানি, খুনি মোশতাকের বিরুদ্ধচারণ দেখিয়েছিলেন তাদের কারাবরণ করতে হয়েছিল। নির্মম নির্যাতন, অমানবিক অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন তাঁরা।
৭ নভেম্বরের পরে এই নির্যাতনের ভয়াবহতা আরো বেড়েছিল। সেই কঠিন এক পরিস্থিতির মধ্যেও আওয়ামী লীগের কিছু নেতা দলটির হাল ধরেছিলেন। তাঁরা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও দল গুছানোর জন্য চেষ্টা করেছিলেন, নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সংগঠনকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। ৭ নভেম্বরের পর থেকে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠনের জন্য নানা রকম ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন বিভিন্ন নেতা, যারা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘আনসাং হিরো’। এই সমস্ত নেতাদের মধ্যে আছেন প্রয়াত জোহরা তাজউদ্দিন, বেগম সাজেদা চৌধুরী, বেগম মতিয়া চৌধুরী, প্রয়াত জিল্লুর রহমান সহ অনেকেই। এদের মধ্যে অনেকে কারা ভোগ করেছেন, র্নিযাতন সহ্য করেছেন। আবার জেল থেকে বেরিয়ে সংগঠন পুনর্গঠন করেছেন। কিন্তু তাঁরা পালিয়ে যাননি। আওয়ামী লীগকে এই অস্তিত্বের যুদ্ধ করতে হয়েছিল ১৯৮১ সাল র্পযন্ত। ১৯৮১ সাল থেকে নানা রকম চড়াই উতরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগ অবশেষে একটি কাউন্সিল করতে সক্ষম হয়। এবং সেই কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু এর আগে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভাজন, নানা রকম মতের পার্থক্য এবং নানা রকম সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল। কিন্তু সেই তীব্র সংকটের মুখেও সব নেতা পালিয়ে যাননি। এর মধ্যেও দু একজন নেতা ছিলেন, যারা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন, যারা কর্মীদেরকে আশ্বস্ত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এবারে চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা পর আওয়ামী লীগের পতনটা ছিল একটা বিষ্ময়কর। এমনকি পয়লা আগস্টও আওয়ামী লীগের কোন নেতাই কল্পনা করতে পারেনি যে এরকম একটি মহাবিপর্যয়ের মুখে তারা পরতে যাচ্ছে। ৫ আগস্ট দুপুর বেলা যখন শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যান, সেই সময় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই ছিলেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তাঁরা কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি। বুঝে উঠতে না পেরে বেশির ভাগ শীর্ষ নেতাই পলায়ন করেছেন। কেউ রূখে দাঁড়াননি, সংগঠনের কথা চিন্তা করেননি।
পঁচাত্তরের আওয়ামী লীগের সঙ্গে বর্তমানের আওয়ামী লীগের মৌলিক পার্থক্য হলো এই ‘মহাপলায়ন’। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের এখন কেউই দেশে নেই। কোন নেতাই সংগঠনের নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়ানো মতো অবস্থায় নেই। কেউই নেতাকর্মীদেরকে কোন নির্দেশনা দিতে পারছেন না। দলে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সব সদস্যই পালিয়ে গেছেন। কেউ ভারতে, কেউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, কেউবা যুক্তরাজ্যে। যারা দেশে আছেন তাদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে (যেমন- দীপু মনি) গ্রেপ্তার হয়েছেন। আরও কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা দেশে আছেন বলে খবর পাওয়া গেলেও তাঁরা পলাতক জীবন যাপন করতেছেন।
পঁচাত্তরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। ২০২৪ সালেও ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। কিন্তু দুইটি আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্য কি? পঁচাত্তরের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের কিছু ত্যাগী পরীক্ষিত আদর্শবান নেতা ছিলেন, সে সমস্ত নেতারা নিজেদেরকে দুর্নীতি, বিভিন্ন অপকর্ম থেকে নিজেদেরকে দূরে সরে রাখতে পেরেছিলেন, যে সমস্ত নেতারা কর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। সাধারণ মানুষ যে সমস্ত নেতাদেরকে পছন্দ করতেন ও ভালবাসতেন। যে সমন্ত নেতাদের সাংগঠনিক দক্ষতা ও যোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। তাদের কারণেই আওয়ামী লীগের পূর্ণঃজন্ম হয়েছিল। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে এর আশ্চর্য ব্যতিক্রম। গত ১৫ বছরে আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ২০০৭ সালের পর থেকেই আওয়ামী লীগ আস্তে আস্তে শেখ হাসিনা নির্ভর একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। এই দলের শীর্ষ সব নেতারা তাকিয়ে থাকতেন শেখ হাসিনার দিকে। তাঁদের একমাত্র কাজ ছিল শেখ হাসিনাকে তুষ্ট করা, শেখ হাসিনার সঙ্গে চাটুকারিতা করা এবং শেখ হাসিনার আস্থা অর্জন করা। এই আস্থা অর্জন করে তারা যা খুশি করার লাইন্সেস পেতেন। নিজেদের আখের গুছানো, দুর্নীতি, লুটপাট করতেই মনোযোগী ছিলেন অধিকাংশ নেতাকর্মীরা। আর দলের ভেতর আরেকটি প্রবণতা গত ১৫ বছরে প্রবল হয়েছিল। দলে অনুপ্রবেশকারী, সুবিধাবাদীকারী, চাটুকারদের ভিড় এবং দলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে এমন কিছু নেতার আর্বিভাব ঘটেছিল যাদের কোনো রাজনৈতিক অতীত নেই। যাঁরা উড়ে এসে জুড়ে বসে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দখল নিয়েছিল এবং দলের নীতি নির্ধারক হয়ে উঠেছিলেন- এই সমস্ত নেতাদের না ছিল আদর্শ চর্চা, না ছিল কর্মীদের সাথে সম্পর্ক। দুঃসময়ে যে এরা পাশে থাকবে না- এ কথা বার বার উচ্চারিত হয়েছিল, বিভিন্ন ভাবে বলাও হয়েছিল। কিন্তু তাতে করে কোন লাভ হয়নি। আজীবন ক্ষমতায় থাকতে বিভোর ছিলো আওয়ামী লীগ।
একটি সংগঠনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ হল দলের সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এখন কোথায়?-এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারো। আওয়ামী লীগের ‘মহাপলায়ন’ এর পর ওবায়দুল কাদেরও এখন পলাতক জীবনযাপন করছেন। তিনি দেশে বাইরে অবস্থান করছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে একজন মাত্র কারাগারে গেছেন, বাকী সকলেই দেশে বাইরে পালিয়ে গেছেন। সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে অবস্থাও তাই। আওয়ামী লীগে যারা উড়ে এসে জুড়ে বসে নেতা ছিলেন সেই অতিথি পাখীরাও এখন লাপাত্তা। তাদের খবরও কেউ জানে না। কর্মীদের উজ্জীবিত করবেন কি, তাঁরা এখন নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত। কেউ নেতাকর্মীদের পাশে নেই। পলাতক নেতারা বিদেশে বসে যে সংগঠনের জন্য কিছু করবেন- এমন কোনো লক্ষণও তাঁর নেই। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতার বাইরেও যারা বিভিন্ন সময় দলের নীতি নির্ধারক হয়ে উঠেছিলেন, ফুলে ফেঁপে উঠেছিলেন তাদেরও এখন কোন দেখা নেই, কর্মীদের পাশে নেই। বিদেশে বসে কোন কোন নেতা নানা রকম বক্তৃতা, বিবৃতি দিচ্ছেন, যা হাস্যকর এবং কর্মীদের ক্ষুব্ধ করছে। কর্মীরা এখন নিজেদের জীবন বাঁচাতে এক বিপন্ন অবস্থায় রয়েছেন। তাদের অনেকে বাড়ি-ঘর ছাড়া, অনেকেই নানা রকম মামলা মোকদ্দমায় এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। এই রকম অবস্থায় তাদের করণীয় কী? এরকম কোন নির্দেশনা দেয়ার মতো কোন লোক নেই। সবকিছু মিলিয়ে আওয়ামী লীগ এখন দিক নির্দেশনাহীন এক তছনছ হয়ে যাওয়া বিধ্বস্ত বাড়ি। এই বাড়ী পুণর্নিমাণ করবেন কে? ১৯৭৫ সালে পুণর্নিমাণের জন্য আওয়ামী লীগের মেহনতী নেতা ছিলেন, যোদ্ধা ছিলেন। এবার এখন পর্যন্ত সেই সমস্ত কিছু দৃশ্যমান নয়। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নানা রকম হুংকার দিচ্ছেন, কেউ কেউ আশায় বুক বেঁধে আছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল যে একটি সংগঠনকে টিকে থাকার জন্য তার সাংগঠনিক তৎপরতা জানান দিতে হয়। একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হয়। আওয়ামী লীগের কোন নেতাই জানে না আওয়ামী লীগ এখন কি করবে? আওয়ামী লীগের পরিণতি কি হবে? এখান থেকে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াবে কিভাবে?- সেটি এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।
Comments
Leave a Comment