Post Thumbnail

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে


আজ ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবস। জেল হত্যা দিবসকে কেন্দ্র করে জাতীয় চার নেতার অন্যতম বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে শারমিন আহমদের একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার আজ প্রকাশ করেছে দৈনিক প্রথম আলো। যেখানে তিনি কথা বলেছেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে। পাঠকদের আগ্রহের কথা বিবেচনায় নিয়ে এখানে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত শারমিন আহমদের সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশ করা হলো:

 

প্রথম আলো: আপনার বই তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা ব্যাপক আলোচিত। অনেক অজানা তথ্য আছে এই বইয়ে। শোনা গেছে, বইটি নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভায়ও আলোচনা হয়েছিল। বইটি লেখার পর তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন? 

শারমিন আহমদ: প্রতিক্রিয়া যেটা পাচ্ছিলাম, সেটা হলো নানা ধরনের সফট পাওয়ারপ্লে হচ্ছিল। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে বইটির ওপর আলোচনা চলছিল, সেখানে চলে এলেন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। আমি ও চট্টগ্রামের তৎকালীন মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন আলোচক। সেখানে তাঁরা এসে আমাকে জেরা করতে শুরু করলেন। একজন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনার বয়স তো তখন ১১, আপনি কীভাবে এগুলো জানলেন?' আমি বললাম, 'আপনি কি ফ্রান্স বিপ্লব দেখেছেন, পলাশীর যুদ্ধ দেখেছেন।' বললেন, 'না।' আমি বললাম, 'তাহলে এই ইতিহাস আমরা জানি কীভাবে? আমরা এসব ইতিহাস জানতে পারি ওই সময়কার বইপুস্তক, সাক্ষাৎকার, অন্যান্য নথি থেকে। এগুলোর ভিত্তিতেই ইতিহাস রচনা হয়।' আমার বলার পর তাঁরা চুপ হয়ে গেলেন। কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই থামল না। এরপর আমরা যখন একটা ডিনারে গেলাম, সেখানে উপস্থিত হলেন চট্টগ্রামের ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের কর্মকর্তারা।

প্রথম আলো: ৩ নভেম্বর 'জেলহত্যা দিবস'। ১৯৭৫ সালের এই দিনে ঘাতকেরা কারাগারে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করে। সেই হত্যার বিচারও হয়েছে। কিন্তু জাতীয় চার নেতাকে কি যথাযথভাবে সম্মান জানানো হয়েছে বলে মনে করেন? 

শারমিন আহমদ: আমি মনে করি, বিচারটা সুষ্ঠুভাবে হলেই সম্মানটা ঠিকভাবে জানানো হতো। ২০০৮ সালে হাইকোর্ট রায়টা দিলেন। এর আগে বিএনপির সময়ে অনেকে ছাড়া পেয়ে যান। যেমন সন্দেহের তালিকায় ছিলেন কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। এ হত্যাকাণ্ডে সেনাবাহিনীর যাঁদের যাবজ্জীবন দেওয়া হয়, তাঁদের অনেকের সাক্ষাৎকার আমি পড়েছি। তাঁরা বলেছেন, 'আমরাও সন্দেহের তালিকায় ছিলাম।' রাজনৈতিক নেতারা যাঁরা সন্দেহের তালিকায় ছিলেন, তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হলো আর সেনা কর্মকর্তাদের যাবজ্জীবন দেওয়া হলো। তাঁরা বলছেন, এখানে একটা বৈষম্য করা হয়েছে। যাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো, সে বিষয়টাও খুব ইন্টারেষ্টিং। রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাশেম মৃধাকে- তিনজন নন-কমিশন্ড সেনাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলো। আপিলের রায়ে দেখা গেল মোসলেম উদ্দিন ছাড়া অন্য দুজনকে বাদ দিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু মোসলেম উদ্দিন কি বেঁচে আছেন, কোথায় আছেন, সেটা আমরা জানি না। এর মানে, পলাতক যাঁদের কথা বলা হচ্ছে, তাঁরা কোথায় আছেন, তাঁদের ওই নামটা সত্যি কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। জেলগেট দিয়ে ঢোকার আগে তাঁরা এসব নাম লিখেছিলেন। কিন্তু সেই নামগুলো সত্যি ছিল কি না, সেটার অনুসন্ধান করা হয়নি। 

প্রথম আলো: আপনি মনে করছেন, জেলহত্যার বিচারটি ঠিকমতো হয়নি?

শারমিন আহমদ: জেলহত্যার মূল ষড়যন্ত্রকারী যাঁরা, যাঁরা ট্রিগারের পেছনে ছিলেন, তাঁরা সবাই বেকসুর খালাস পেয়ে গেছেন। আমি মনে করি, ন্যায়বিচারের স্বার্থে জেল হত্যাকাণ্ডের বিচার রিভাইব করা প্রয়োজন।

এখানে আরেকটি প্রশ্ন তুলতে চাই, কয়েক বছর আগে আমরা দেখলাম, বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যায় জড়িত মাজেদ, যিনি প্রায় ২০ বছর ভারতে বসে ছিলেন, এরপর বাংলাদেশে চলে এলেন ও গ্রেপ্তার হলেন। এরপর সাত দিনের রিমান্ড শেষে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হলো। কিন্তু তিনি জিজ্ঞাসাবাদে কী বলেছিলেন, সেটা জানা গেল না। আবার বলা হচ্ছে, মাজেদ ভারতে ছিলেন। কিন্তু ভারতের গোয়েন্দারা কি মাজেদের সেখানে থাকার তথ্যটা জানত না? জিজ্ঞাসাবাদে মাজেদ কী জবানবন্দি দিয়েছেন, সেটা জানার অধিকার আমাদের আছে।

প্রথম আলো: আপনারা ৩ নভেম্বর জেলহত্যা রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনসহ সরকারের কাছে তিন দফা দাবি জানিয়েছেন। এই দাবি কেন জানালেন।

শারমিন আহমদ: আমরা কোনো সরকারি ছুটির দিন চাই না, কালো পোশাকও চাই না, আমরা চাই রাষ্ট্রীয়ভাবে ও নভেম্বরের স্বীকৃতি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এদিনটা নিয়ে আলোচনা হবে। জাতীয় নেতাদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম জানবে। সেটা জানলে একটা জাতীয় গৌরব অনুভব করবে। যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে কাপড় কেচে, ধুয়ে শুকিয়ে পরের দিন সেটা পরেছেন। বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রী এটা করেছেন। যুদ্ধের সময়ে তিনি পারিবারিক জীবন যাপন করেননি। কারণ, তিনি বলতেন, 'আমি সব মুক্তিযোদ্ধার নেতা, তারা তো পরিবারের সঙ্গে নেই।'

প্রথম আলো: আপনাদের পরিবার পুরোপুরি রাজনৈতিক পরিবার। তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, আপনার মা জোহরা তাজউদ্দীন পঁচাত্তরের পর দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আপনার বোন সিমিন হোসেন রিমি ও ভাই সোহেল তাজ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনীতি নিয়ে আপনার এখনকার চিন্তাভাবনা কী?

শারমিন আহমদ: গত সাড়ে ১৫ বছরে আমরা গণতন্ত্রহীন একটা জায়গায় ছিলাম। এখনকার পরিস্থিতিটা খুব অস্থির। আমি বলব, বাহাত্তর সাল থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধটা হ্যাইজ্যাক হয়ে গিয়েছিল। একটা বিপ্লবী চেতনায় বাংলাদেশটা সৃষ্টি হয়েছিল। অথচ ১ লাখ ১ হাজার (যুদ্ধদিনের নেতা তাজউদ্দীন আহমদের সংখ্যাটির কথায় পত্রিকায় উল্লেল্লখ করেছিলেন) মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্র সমর্থণ করিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো। ৩ লাখ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানো হলো এবং মুজিব বাহিনীর সদস্যদের কাছে অস্ত্র রয়ে গেল। এখানেই তো বিভাজনের শুরু। মুজিব বাহিনী তো মুক্তিযুদ্ধের সরকারটাকেই স্বীকার করেনি। এরপর আমরা দেখলাম খন্দকার মোশতাকের মতো মানুষদের পুনর্বাসন করা হলো।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের পরিকল্পনা ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ দিয়ে, তাঁদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে বাড়ি না পাঠিয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাজে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল তাজউদ্দীন আহমদের। একটা বিশ্বয় হলো, রাজনৈতিক দল গঠন করলেই রাজনীতি হয় না। রাজনীতির জন্য একটি দূরদৃষ্টি দরকার। এই যে জুলাই-আগষ্টে ছাত্র-জনতার যে অত্যুত্থানটা হলো, এর স্পিরিটটা কিন্তু একেবারে খাঁটি। সবাই পরিবর্তনটা চেয়েছে। আমি দেশে আসার পর কয়েকটি হাসপাতালে গিয়ে আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করেছি। দেখেছি, তাঁদের বেশির ভাগই কোনো দল করেন না।। তাঁরা দেখেছেন অন্যায় হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমেছেন। জীবন চালাতে তাঁদের অসহনীয় কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, অথচ তাঁদের বলা হয়েছে তোমরা কাঁঠাল যেয়ে থাকো। অন্যদিকে ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। 

প্রথম আলো: দেশের বর্তমান রাজনীতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

শারমিন আহমদ: রাজনীতির মূল লক্ষ্য অবশ্যই ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় না গেলে নীতি বাস্তবায়ন করা যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ক্ষমতাটা কি লোভের জন্য দরকার; আমি আরও বেশি টাকা বানাব, আমার আত্মীয়স্বজনের। পুনর্বাসন করব; নাকি লাখো কোটি দরিদ্র সন্তান, তাদের বেকারত্ব, তাদের জীবযাপনের সংকট-এসব সমস্যার সমাধান করে দেশটা গড়ব। এখানে একটা জাতীয় ঐক্যের দরকার হয়ে পড়েছে। এখন যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁদের বুঝতে হবে, সমাজে ভিন্ন ভিন্ন মত থাকবে, সবার কথা শুনতে হবে। এটার মানে আমি বলছি না আমরা আগের কোনো স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় যাব। আমার দৃষ্টিভঙ্গি, আপনার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা হতে পারে, কিন্তু একটা ব্যাপারে ঐকমত্য থাকতে হবে যে আমরা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেব না, নির্বাচনী ব্যবস্থাটা শক্তিশালী হবে, বিচার বিভাগ পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা থাকবে।

প্রথম আলো: ছাত্র-জনতার অত্যুত্থানে অংশ নিতে গিয়ে যাঁরা আহত হয়েছেন, আপনি হাসপাতালে তাদের দেখতে গিয়েছিলেন। আপনার অনভূতি কী?

শারমিন আহমদ: শরীরে এখনো এক শর বেশি বুলেট নিয়ে, মেরুদণ্ডের মধ্যে, হাড়ের মধ্যে বুলেট নিয়ে যাঁরা এখনো হাসপাতালে রয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। আমি সিআরপিতে গিয়ে তাঁদের যন্ত্রণার কথা শুনেছি। এটি সক্রিকারের একটা জনবিপ্লব। কোনো দোস্তী রাজনৈতিক দল যেন এই বিপ্লবের ফসলটা তাদের ঘরে তুলতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। এই শ্রমজীবী মানুষগুলোর স্বীকৃতি দেওয়া সরকারের অগ্রাধিকারে থাকতে হবে। কারণ, গণ-অভ্যুত্থানের যে বিপ্লবী চেতনা, তা তাঁরা নিজেদের শরীরে ধারণ করছেন। তাঁদের স্বীকৃতি দিলে, সম্মান দিলে, রাজনৈতিক দলগুলোও গণতন্ত্রের পথে চলে আসবে। এই চেতনাকে আমরা কোনোভাবেই দমিয়ে দিতে পারি না। এই ভুলটা আমরা একবার করেছিলাম দেশ স্বাধীনের পর।

প্রথম আলো: আগের সরকারের আমলে গণতন্ত্র, নির্বাচনী ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, খুন ও ভয়াবহ দুর্নীতি ঘটেছে, সেটাকে কীভাবে দেখছেন? 

শারমিন আহমদ: সেটা আওয়ামী লীগের শাসন ছিল নাকি হাসিনা লীগের শাসন ছিল? প্রকৃতপক্ষে সেটা একটা পরিবার লীগের শাসন ছিল। কারণ, আওয়ামী লীগের কথা আমি যখন চিন্তা করি, তখন মাওলানা ভাসানীর কথা চিন্তা হয়, শামসুল হকের কথা চিন্তা হয়। আমার বাবা তাজউদ্দীনের কথা মনে হয়। এমনকি একাত্তর-পূর্ববর্তী বঙ্গবন্ধুর কথাও চিন্তা হয়। তাঁরা গণমানুষের প্রতিনিধি ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগটা হাইজ্যাক হয়ে যায় একটা পরিবারের কাছে। একটা পরিবারতন্ত্র হয়ে উঠেছিল, তাঁরা আওয়ামী লীগের ব্যানারটা ব্যবহার করেছিলেন।

সে জন্য আমার কাছে মনে হয়, আওয়ামী লীগের মধ্যে যেসব নেতা-কর্মীর বিবেক এখনো জামত আছে, তাঁরা যদি সবাই প্রতিবাদী হয়ে হাসিনা লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটা সুস্পষ্ট পার্থক্যরেখা টানতে পারেন, তাহলেই আওয়ামী লীগের একটা রাজনৈতিক সম্ভাবনা থাকবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এত এত দুর্নীতি হয়েছে, এর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের থেকেই ডাকটা আসা উচিত। তাঁরা যদি বুদ্ধিমান হন, তাঁরা যদি সত্যিই আওয়ামী লীগকে ভালোবাসেন, তাহলে তাঁদের বলতে হবে যে তাঁদের দলে কোনো ক্রিমিনাল থাকবে না। শেষ হাসিনা ও তাঁর আশপাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সবাই ক্রিমিনাল। তাঁদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এই দাবিকে বাইরের লোক শুধু কেন করবে? বিচারের দাবি কেন আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে আসবে না? 

প্রথম আলো: ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের বয়স ৮৩ দিন পূরণ হলো। তারা জন-আকাঙ্ক্ষা কতটা পূরণ করতে পেরেছে? 

শারমিন আহমদ: সবাই কিন্তু বলছেন, তাঁরা দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখতে পারছেন না। এটা তরুণেরাও বলছেন, রিকশাচালকেরাও বলছেন। জিনিসপত্রের দাম অবশ্যই কমিয়ে আনতে হবে। সিন্ডিকেটের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হবে। মানুষের পেটে খাবারটা থাকলেই জনসমর্থনটা আসে। অভ্যুত্থানের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, যাঁদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা ছিল, প্রতিটি সেক্টরে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তরুণদের নেতৃত্বেই দেশে একটা ভালো রাজনৈতিক পরিবর্তন আসতে পারে। সরকারের আরেকটি জায়গায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। আন্দোলনে যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে; যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ রাখতে হবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাঁদের পুনর্বাসন করতে হবে।

প্রথম আলো: সরকার তো নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে... 

শারমিন আহমদ: না, উদ্দ্যোগটা যথেষ্ট নয়। আমার ছেলের একটা সংগঠন আছে, ওরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দীসহ বিভিন্ন হাসপাতালের ৫০০ আহত ব্যক্তিকে নিয়ে একটা জরিপ করেছে। তাদের জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৮৫ শতাংশের বেশি আহত কোনো দলও করে। না। কিন্তু তারা কেন আন্দোলনে গেল? সুনামগঞ্জের একটা ছেলে জহিরুল্লাহ। তার একটা প্লাটিকের দোকান আছে। নতুন বিয়ে করেছে। গুলির ক্ষত নিয়ে এখনো হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। জহিরুল্লাহ আমাকে বলেছে, যখন দেখেছে মুগ্ধ পানি দিতে গিয়ে মারা গেল, তখন সে রাস্তায় নেমেছে। এই যে মরতে ওয় না পাওয়ার চেতনাটা, এটা কিন্তু একটা জাতির ইতিহাসে শতাব্দীতে একবারই আসে। যে মুহূর্তেই মানুষ মনে করে তারা মরতে ভয় পায় না, সেই মুহূর্তেই মানুষ জয়ী হয়। সুতরাং, এই মানুষদের আমাদের সম্মান করতে হবে। আপনি যদি জিজ্ঞাসা করেন তাহলে আমি বলব, এটাই কিন্তু আমার রাজনীতি।

প্রথম আলো: রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের এখন কী করা উচিত? নতুন করে যাত্রা শুরুর আগে কি তাদের অতীতের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত নয়? 

শারমিন আহমদ: অবশ্যই তাদের ক্ষমা চাইতে হবে। কোনো রাজনৈতিক কারণে নয়, অনুশোচনাটা সত্যিকারের মন থেকে আসতে হবে। মানুষ যখন দেখবে আচরণে, চিন্তায়, কথাবার্তায় পরিবর্তন এসেছে, তাহলে ধীরে ধীরে তাদের নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থাটা ফিরতে শুরু করবে। কারণ, তারা তো এই সমাজেরই সন্তান। আমি মনে করি, তারা যদি নিজের থেকে এগুলো করে, তাহলে ভবিষ্যতে তারা ভালো করবে। 

প্রথম আলো: একাত্তরে তাজউদ্দীন আহমদ প্রবাসী সরকার গঠন ও পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে আপনি, সিমিন হোসেন রিমি ও সোহেল তাজের ওপর কোনো দায়িত্ব এলে সেটা নেবেন কি? 

শারমিন আহমদ: যে বাঁচতে চায়, তাকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা থাকে। যে মরে যেতে চায়, তাকে আপনি কীভাবে বাঁচাবেন। আওয়ামী লীগের উচ্চ মহল, শেখ হাসিনার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে সোহেল- আমাদের কাছে ফোনকল এসেছে। তাঁরা জানতে চেয়েছেন, আওয়ামী লীগের হালটা ধরব কি না। আমি তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছি যে '৭৫-পরবর্তী সময়ে জোহরা তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন। তখন কিন্তু আওয়ামী লীগের অবস্থা এখানকার চেয়ে অনেক ভালো ছিল। আমার মা যখন আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের প্রায় সবাই তৃণমূলের রাজনীতি থেকে উঠে আসা মানুষ। আমার মায়ের কথা ছিল, যোগা, মেধাবীদের সংগঠনে রিক্রুট করো। কিন্তু সংগঠনে কে আসবে, কে আসবে না, তা নিয়ে তিনি কোনো হস্তক্ষেপ করতেন না। ফলে সংগঠনে মেধাবী তরুণেরা আসতে শুরু করল। কিন্তু এর পরিণতি কী হলো? আম্মা যখন আওয়ামী লীগকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে আসতে শুরু করলেন, দলকে একটা শক্ত জায়গায় নিয়ে এলেন, তখন কী হলো। আব্দুর রাজ্জাক সাহেবরা দিল্লি থেকে শেষ হাসিনাকে নিয়ে এলেন। এরপর আওয়ামী লীগ আর দলের থাকল না। পরিবারের হয়ে গেল। আমি ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র পছন্দ করি না। কেউ যদি নতুন আসে, আমরা তাদের জন্য কাজ করব। কিন্তু তাজউদ্দীনের সন্তান হিসেবে আমরা রাজনীতিতে আসতে চাইব না। 

যাঁরা ফোনকল করেছেন, আমি তাঁদের বলেছি, আপনারা আবার তাজউদ্দীনের পরিবারের কাছে আসছেন! আপনারা নিজেরা দলকে ধাংস করে এখন চাচ্ছেন আবার আমরা আসব, দলকে গড়ে দেব। এরপর আপনারা ফিরে এসে সেটার ফল নেবেন? এবার আমরা এই অবস্থান নিয়েছি যে আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে অনুশোচনা আসুক, আত্মোপলব্ধি আসুক। জনগণের কাছে তাদের ক্ষমা চাইতে হবে। প্রত্যেক আহত ব্যক্তির কাছে, প্রত্যেক নিহত ব্যক্তির পরিবারের কাছে গিয়ে মাফ চাইতে হবে। যে টাকা বিদেশে পাচার করে নিয়েছেন, সেটা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।

প্রথম আলো: ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। এই নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হলে ভূরাজনীতিতে তার প্রভাব কতটা পড়বে? 

শারমিন আহমদ: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি খুব একটা পরিবর্তন হয় না। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বুশের সময় ইরাকে হামলা হলো। এরপর ডেমোক্র্যাট ওবামার সময়ে ইরাকে সবচেয়ে বেশি ড্রোন হামলা হলো। সবচেয়ে বেশি বেসামরিক মানুষ হতাহত হলেন। এর কারণ হলো ক্রোনি ক্যাপিটালিজম। যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্রের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ। যে করপোরেশন রিপাবলিকানদের তহবিলে চাঁদা দেয়, তারাই আবার। ডেমোক্র্যাটদের টাকা দেয়।


Comments

Leave a Comment


Related Articles