প্রতিহিংসার পাপ এবং প্রায়শ্চিত্ত
সৈয়দ বোরহান কবীর: নিউটনের তৃতীয় সূত্র বলে, প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন ‘সকাল বেলা আমির রে ভাই/ ফকির সন্ধ্যা বেলা’। সব শাস্ত্রই বলে আপনি যা করবেন তার প্রতিদান আপনাকে পেতেই হবে। কিন্তু শাস্ত্র, বিজ্ঞান কিংবা ধর্ম কোনটাই যেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেউ মানে না। যারা যখন ক্ষমতায় বসে তারা মনে করে এই ক্ষমতা তার প্রতিহিংসার অস্ত্র। ক্ষমতার প্রচন্ড দাপটে যারা প্রতিপক্ষকে হয়রানি করা, নিঃশেষ করে দেয়ার এক উন্মত্ত উৎসব চলে। যখন যারা ক্ষমতায় আসে তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়, প্রতিশোধ গ্রহণ। আগে তার সাথে যা যা অন্যায় হয়েছিলো তার সাথে দ্বিগুন গতিতে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হয়। এই প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে সাধারণ মানুষ। কেউ বোঝে না কাল তার সাথেও ঘটতে পারে এরচেয়ে ভয়ংকর কিছু।
প্রতিহিংসা একটি পাপ। আর এই পাপের জন্য একসময় তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিহিংসার পাপ এবং প্রায়শ্চিত্ত যেন এক নিয়তি। এটি পায়ে পায়ে হাটছে। আমাদের রাজনীতি যেন প্রতিহিংসার পাপ এবং প্রায়শ্চিত্তের এক দুষ্ট চক্রে বন্দি হয়ে আছে। যখন যারা ক্ষমতায় এসেছে তখন তারা প্রতিপক্ষের উপর নির্দয় হয়েছে। প্রতিপক্ষকে নির্মূল এবং নিঃশেষ করতে চেয়েছে। আর প্রতিপক্ষ এই প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে-পুড়ে আরো শক্ত হয়েছে। লোহা যেমন আগুনে পুড়ে ইস্পাতের মতো দৃঢ় হয় ঠিক তেমনি প্রতিপক্ষরা প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে-পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় না। বরং তারা আরো দ্বিগুণ শক্তিতে নিজেদের সংহত করে। তারপর একসময় প্রতিপক্ষের দিন আসে। প্রতিপক্ষ ক্ষমতায় বসে। তখন তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয় প্রতিশোধ গ্রহণ। জনগণ, দেশ সবকিছু চুলোয় যাক।
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম তিন মাস দেখে মনে হচ্ছে সেই প্রতিহিংসার পাপের দুষ্ট চক্র থেকে আমরা বেরুতে পারিনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেই বলেছিলো একটি নতুন বাংলাদেশ হবে। এটি দ্বিতীয় স্বাধীনতা। এখানে কেউ কারো প্রতিপক্ষ নয়। মন খুলে কথা বলা যাবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ৮ আগস্ট দেশে ফিরে বিমানবন্দরে বলেছিলেন, ‘আমরা একটি পরিবার।’ শপথ গ্রহণের পরও তিনি আবারো একই কথা উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু গত তিন মাসের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে, প্রতিশোধ গ্রহণ, প্রতিহিংসা চরিতার্থ দখল আর নাম বদলের এক উৎসব চলছে। এই প্রতিহিংসা কি পারবে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করে দিতে?
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, উন্নয়ন বা অগ্রযাত্রার আড়ালে ছিলো প্রতিহিংসার এক হিংস্র রূপ। প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দেয়া, নির্মূল করে দেয়ার সবগুলো অস্ত্র প্রয়োগ করেছিলো আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের এই প্রতিশোধ এবং প্রতিহিংসার পাপের ফল কি হয়েছে তা গোটা জাতি দেখেছে ৫ আগস্ট। আওয়ামী লীগের নির্মম ‘মহা পলায়ন’ ঘটেছে। আওয়ামী লীগের নেতারা এখন পালিয়ে বাঁচতে চাইছেন। নিরাপদ দূরত্বে চলে গেছেন বেশির ভাগ নেতা। যারা দেশে আছেন তাদেরও প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই। আওয়ামী লীগের এই প্রতিহিংসার রাজনীতি শুধু আওয়ামী লীগের জন্য না বাংলাদেশের রাজনীতির জন্যই একটি বড় শিক্ষা। কিন্তু এই শিক্ষা কি আমরা নিচ্ছি? সাম্প্রতিক সময়ে যা চলছে তার সবকিছু দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, প্রতিহিংসার পাপ আবার সংক্রমিত হচ্ছে। ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি করতে চায় তা, এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। বরং তারা তাদের মূল লক্ষ্য হিসেবে প্রতিহিংসাকে বেছে নিয়েছে বলেই এখন পর্যন্ত প্রতীয়মান হচ্ছে। দেশ গঠন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেয়ে তাদের আগ্রহ বেশি প্রতিশোধে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে দেশে ফ্যাসিস্ট শেখ হসিনা কিংবা আওয়ামী লীগের কোন জায়গা নেই।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই বক্তব্যটি সবগুলো জাতীয় দৈনিকে অত্যন্ত ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। ‘ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের বাংলাদেশে কোন জায়গা নেই’ এই সিদ্ধান্তটি প্রধান উপদেষ্টা বিদেশী গণমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের বা শেখ হাসিনার বাংলাদেশে জায়গা হবে কি হবে না এই সিদ্ধান্ত কে নেবে? এই সিদ্ধান্ত নেবে দেশের জনগণ। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তার মতামত জানাবে। ড. ইউনূস যদি মনে করে, তিনি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন তাহলে সেটি কি সঠিক হবে? একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, ড. ইউনূস গত ১৫ বছরে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে একাধিক মামলা হয়েছিলো। আয়কর ফাঁকি ও দুর্নীতির নানা মামলা তাকে নাস্তানাবুদ করেছিলো। অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার উপর তাঁর ক্ষোভ থাকা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু যখন তিনি একটি জাতির অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, একটি গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসবেন তখন যদি তিনি প্রতিহিংসা এবং প্রতিশোধের আগুনকে চাপা দিয়ে রাখতে পারেন তাহলেই তাঁর মহত্বতা প্রকাশ পাবে। তা না হলে তার সাথে অন্যদের পার্থক্য কোথায়? ড. ইউনূস যে সাক্ষাৎকারটি দিয়েছেন সেই সাক্ষাৎকারটিতে একধরনের প্রতিহিংসা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আমি সব সময় মনে করি, আওয়ামী লীগের অনেক সমালোচনা আছে। ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের অনেক পাপও রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবে কি পারবে না কিংবা আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ পরিণতি কি হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার একমাত্র জনগণের। কোন ব্যক্তির নয়।
শুধু শেখ হাসিনার দেশে ফেরা বা না ফেরা নিয়ে নয়। গতকাল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এক সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। সেই সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার ব্যাপারে চিঠি দেয়া হয়েছে বলেও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান। উল্লেখ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিস রয়েছে। বাংলাদেশ যে অঞ্চলে সেই অঞ্চলের আঞ্চলিক শাখা ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালকরা আঞ্চলিক শাখার নেতৃত্ব দেন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যতোটুকু পারে আঞ্চলিক প্রধানদেরকে স্বতন্ত্র এবং স্বাধীনতা দেয়। দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এভাবেই কাজ করে আসছে। গত নভেম্বরে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সেই নির্বাচনে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল নির্বাচিত হন। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এটি কোন রাজনৈতিক পদ নয়। এছাড়াও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এই পদটি তাঁর মায়ের কারণেও অর্জন করেননি। তিনি তাঁর যোগ্যতা এবং মেধা দিয়ে এই পদের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। এই পদটি বাংলাদেশ সরকারের দেয়া কোন পদ নয়। কোন দয়ার দানও না। এই অঞ্চলের সদস্য রাষ্ট্রদের ভোটে নির্বাচিত সায়মা।
সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা হয়েছে, অনেকগুলো অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। কেবল মাত্র অভিযোগ একজন ব্যক্তিকে ‘দোষী’ প্রমাণিত করে না। আইনের দৃষ্টিতে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ আদালতে দোষী প্রমাণিত না হবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে নির্দোষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তাহলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব অভিযুক্ত একজন ব্যক্তির সঙ্গে কাজ না করার দাবি কিভাবে উত্থাপিত করেন? তিনি কি মনে করেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই আবেদনে সাড়া দেবে? নাকি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এতে উজ্জ্বল হবে? এই ধরনের প্রবণতা গুলো প্রতিহিংসারই একটি প্রকাশ বলে অনেকে মনে করেন।
সায়মা ওয়াজেদের বিরুদ্ধে যে মামলা গুলো হয়েছে সেই মামলাগুলো যদি চূড়ান্ত, নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে নিস্পত্তি হয় এবং সেখানে যদি তিনি দোষী প্রমাণিত হন তাহলে আপনা আপনিই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় তাঁর থাকা হবে না। কিন্তু তিনি শেখ হাসিনার কন্যা এজন্য তাঁর সাথে বাংলাদেশ কাজ করবে না এধরনের বক্তব্য কি ছেলে মানুষি নয়? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠান। এই ধরনের রাগ অভিমানের ছেলে মানুষী আবদার আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
ড. ইউনূস তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুানালের রায়ের পর শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে।’ তাহলে কি আমরা ধরেই নিচ্ছি আন্তর্জাতিক অপরাধে শেখ হাসিনা দন্ডিত হবেন? এমনও হতে পারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাকে বেকসুর খালাস দেয় হলো। একটি বিচারের সবচেয়ে বড় দিক হলো অনিশ্চয়তা। বাদী এবং আসামি কেউই জানেন না রায় কি হবে। বিচারক বাস্তবতার নিরিখে এবং সবকিছু বিবেচনা করে রায় প্রদান করবেন। এরকম একটি পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা যদি আগে থেকেই বলে যে, রায়ের পর তাকে ফিরিয়ে আনা হবে। তাহলে কি আমরা ধরেই নিচ্ছি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুানালের রায়ে শেখ হাসিনাকে দন্ডিত করা হবে? এটা তো বিচারের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন তুলবে।
প্রতিহিংসার পাপে কি হয় আওয়ামী লীগ তার প্রমাণ। অতীতেও আমরা দেখেছি। প্রতিহিংসার রাজনীতি করে বিএনপিকে ১৫ বছর এক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। ৭১-এ প্রতিহিংসার রাজনীতি করে জামায়াত এখন পর্যন্ত জনগণের বিশ্বাস এবং আস্থা অর্জন করতে পারেনি। ড. ইউনূস জাতির অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশকে একটি পরিবার করতে চান। কাজেই এই সরকারকে প্রতিহিংসার পথ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তিগত ক্ষোভ-আক্রোশ এবং ব্যক্তিগত মান-অভিমানকে দূরে রেখে একটি ভালোবাসা এবং শান্তির দেশ বিনির্মাণ করতে হবে। নাহলে প্রতিহিংসার পাপের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করতে হবে সকলকেই।
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
Comments
শাহানা পারভীন
2 months agoপ্রতিহিংসা নামক এক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ মেতে উঠেছে এই প্রতিহিংসা যদি বন্ধ না হয় বাংলাদেশ নামক জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করার অসাধারণ লেখাটির জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
অমিত কুমার দে
2 months agoশুধু প্রতিহিংসা নয়; ক্রোধ এবং প্রতিহিংসা উভয় মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি আমাদের সকলের। ভিতরের ষড়রিপু জয় করা এক্ষেত্রে অতীব জরুরি। ধন্যবাদ আপনাকে।
Leave a Comment