কাদেরের নিখোঁজ সংবাদ
৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের নেতারা যে যেখানে পেরেছে পালিয়ে গেছে। খুব কম সংখ্যক নেতাই দেশে আত্মগোপন করে আছেন। যারা আত্মগোপন করে আছেন তারাও একে একে গ্রেপ্তার হচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা রয়েছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের অধিকাংশই এখন পলাতক। তারা বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছেন। বিদেশে অবস্থান করে অনেকেই আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। অনেকেই নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা রকম বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে কর্মীদের চাঙ্গা করার চেষ্টাও করছেন। কেউ কেউ আবার নিজের অবস্থান জানান দেয়ারও চেষ্টা করছেন। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু একজন। আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি। যিনি এখনও কাগজে কলমে দলের সাধারণ সম্পাদক। সেই ওবায়দুল কাদের।
৫ আগস্টের আগে ওবায়দুল কাদের একাধিক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘পালাবো না।’ প্রয়োজনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাড়িতে যাওয়ার কথাও তিনি বলেছিলেন। এনিয়ে ৫ আগস্টের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ওবায়দুল কাদেরকে ঠাট্টা করতেও ছাড়েননি। বিএনপি মহাসচিব ওবায়দুল কাদের কোথায় জানতে চেয়ে বলেছেন, ‘আমার বাসায় আসেন।’ কিন্তু ওবায়দুল কাদের মির্জা ফখরুলের বাসায় যাবে কি, আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গেই তার যোগাযোগ নেই। ৫ আগস্টের পর ওবায়দুল কাদের কোথায় আছেন, কিভাবে আছেন, সেই সম্পর্কে আওয়ামী লীগের কোন নেতার কাছেই কোন তথ্য নেই। আওয়ামী লীগের কোন পর্যায়ের সাংগঠনিক নেতাদের সঙ্গেই তার কোন যোগাযোগ নেই।
আওয়ামী লীগের প্রায় সবাই একটি বিষয়ে একমত। আর তা হলো, দলটির যে সাংগঠনিক হাল, হতশ্রী অবস্থা তার জন্য অন্যতম দায়ী ব্যক্তি ওবায়দুল কাদের। ওবায়দুল কাদের টানা তিন মেয়াদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এসময় তিনি সংগঠনের বারোটা বাজিয়েছেন এমনটি মনে করেন অধিকাংশ নেতা-কর্মী। বিশেষ করে যেসমস্ত নেতা-কর্মীরা এখন দেশে অবস্থান করছেন, নানা রকমভাবে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছেন কিংবা পালিয়ে জীবন রক্ষা করছেন, আত্মগোপনের এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতাকে বরণ করে নিয়েছেন তারা সকাল সন্ধ্যা ওবায়দুল কাদেরকে শাপ-শাপান্ত করছেন। তারা মনে করেন, ওবায়দুল কাদের এই সংগঠনটিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের ভেতর একদিকে যেমন ক্ষমতালোভী, সুবিধাভোগী, চাটুকার, দুর্নীতিবাজদের প্রচন্ড দাপট ছিলো গত পনেরো বছর। তেমনি সংগঠন দখল করে ফেলেছিলো হাইব্রিড, সুবিধাবাদী, অনুপ্রবেশকারীরা। দলের যারা সত্যিকারের ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং আদর্শবান নেতা-কর্মী তারা রীতিমতো মূল কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়েছিলেন। তারা অনাহূত, অবহেলিত ছিলো। একদিকে তাদেরকে কোন ধরনের নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হয়নি অন্যদিকে সাংগঠনিক পদগুলো দেয়া হয়েছে টাকার বিনিময়ে অনুপ্রবেশকারী, সুবিধাবাদী এবং দুর্নীতিবাজদের। কিন্তু মজার বিষয় হলো, আওয়ামী লগি যখন ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর ‘মহা পলায়ন’ করেছে তখন সেই সমস্ত সুবিধাবাদী, হাইব্রিড, অনুপ্রবেশকারীরা দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন নিরাপদে। যেসমস্ত নেতারা টাকার বিনিময়ে কমিটি করেছিলেন, পদ বিক্রি করেছিলেন, মনোনয়ন বাণিজ্য করেছিলেন তারা কোটি কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে বিদেশে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে বসে তারা কাটাচ্ছেন আয়েশী জীবন।
আওয়ামী লীগের একজন কর্মী বলছিলেন আওয়ামী লীগের কিছু কিছু নেতা এতো বিপুল সম্পদ বানিয়েছেন যে সারা জীবন কিছু না করলেও তাদের চলবে। এসমস্ত নেতারা এখন নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে কর্মীদেরকে নানা রকম নির্দেশ পরামর্শ দিচ্ছেন। এই নির্দেশ পরামর্শগুলো কর্মীদের কাছে হাস্যকর হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এধরনের নির্দেশ পরামর্শ দেয়ার নৈতিক অধিকার কি তারা রাখেন? নিজেরা দূরত্বে থেকে কর্মীদের আগুনে ঝাঁপ দিতে বলা কি কোন নেতার কাজ?
দেশে থাকা আওয়ামী লীগের কর্মীরা প্রতিদিন এক দুর্বিষহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কোন কর্মী তার বাড়িতে থাকতে পারছেন না। অনেক কর্মীকে নানা রকম বঞ্চনা নিপীড়নের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। বহু কর্মী মার খেয়েছেন, গ্রেপ্তার হয়েছেন, অনেকে মারা গেছেন। এই সময় নেতারা তাদের পাশে নেই। যারা আওয়ামী লীগ থেকে কিছুই পাননি তারাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হচ্ছেন। আর এসমস্ত কিছুর জন্য দায়ী ওবায়দুল কাদের। এমনটিই মনে করছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সভাপতি দলের প্রধান ব্যক্তি হলেও দলের সাংগঠনিক তৎপরতা কার্যক্রমগুলো পরিচালিত হয় সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে। সাধারণ সম্পাদক যেমন সারা দেশে দলের সংগঠনিক কর্মকান্ড, কমিটি, দলে শৃঙ্খলাকে পর্যালোচনা করে নিয়ন্ত্রণ করেন তেমনি সংগঠনকে শক্তিশালী করার প্রধান দায়িত্বও তার। কিন্তু ওবায়দুল কাদের এই কাজটি না করে একদিকে যেমন তিনি সীমাহীন দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জ্বিত হয়েছিলেন অন্যদিকে শুধুমাত্র নানা রকম বস্তা পঁচা, একঘেঁয়ে, হাস্য কৌতুকের রগরগে কথা বলে জনবিরক্তি সৃষ্টি করেছিলেন। শেষ দিকে তিনি নেতা নন, একজন কৌতুক অভিনেতা বা ভাড়ের স্বীকৃতি পান।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছিলো তারও একটি বড় কারণ হলো ওবায়দুল কাদের। ওবায়দুল কাদেরের জন্যই ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হয়েছে এটি মনে করেন ছাত্রলীগের প্রায় অধিকাংশ নেতা-কর্মী। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগই যথেষ্ট এমন মন্তব্য করে তিনি পুরো পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে দিয়েছিলেন। আর এসমস্ত কারণেই ওবায়দুল কাদের এখন আওয়ামী লীগের কাছেই ‘গণশত্রু’ বিশ্বাসঘাতক। তার নিখোঁজ সংবাদ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিস্মিত করেনি। বিভিন্ন সূত্র বলছে তিনি সিঙ্গাপুরে আছেন। আবার কেউ বলছেন তিনি দুবাইয়ে আছেন। তবে তিনি যেখানেই থাক না কেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাছে তিনি একজন ঘৃণার পাত্র ছাড়া আর কিছু নন। আওয়ামী লীগ অন্তত একটা প্রায়শ্চিত্ত করতে পারে, আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে কাদেরকে বহিস্কার করতে পারে দলটি। তাহলে বোঝা যাবে অন্তত একটু আত্মোপলব্ধি তাদের হয়েছে।
Comments
Leave a Comment