ফলকার টুর্ক-এর ঢাকা সফর এবং বাংলাদেশের মানবাধিকারের চিত্র
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সরকারের বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগের মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ছিলো অন্যতম একটি। বিশেষ করে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের সাতজন কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এটি ব্যাপক ভাবে আলোচনায় আসে। দেশে এবং দেশের বাইরে সরকার এই ইস্যুতে তীব্র সমালোচনার শিকার হয়। বিশেষ করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশের মানবাধিকার ইস্যুতে ছিলো সোচ্চার।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর আগে ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত কার্যত দেশে কোন সরকার ছিলো। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিলো অন্তত নাজুক। পুলিশ বাহিনী দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ দেখায়। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে এবং এসময় দেশে ব্যাপক গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। এ সমস্ত ঘটনায় অনেকের প্রাণিহানিও ঘটেছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনা সারাদেশে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি করে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই ঘোষণা দেন জনগণের কাঙ্খিত নতুন বাংলাশে গড়ার। ঘোষণা দেন সংস্কারের। এজন্য ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ছয়টি সংস্কার কমিশনের ঘোষণা করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। যদিও এসমস্ত সংস্কার কমিশন ঘোষণা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছুটা আক্ষেপ দেখা গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, তাদের সাথে আলোচনা না করেই এসমস্ত কমিশন ঘোষণা করা হয়েছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর আক্ষেপ থাকলেও জনসাধারণের মধ্যে এসমস্ত কমিশন গঠনের প্রশংসা কুড়িয়েছেন ড. ইউনূস। ড. ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের আজ ৮৪ দিন অতিক্রম করছে। এরই মধ্যে বেশি কিছু বিষয় নিয়ে সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে তাঁর সরকারকে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি সহ মানবাধিকার ইস্যুটি বেশ জোরেসোরে সামনে এসেছে।
বাংলাদেশ যখন একটি সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখন গত সোমবার দিবাগত রাতে দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। তাঁর এই সফরেরও দেশের মানবাধিকার ইস্যুটি ব্যাপক ভাবে আলোচিত হয়েছে। এসময় তিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ এবং যৌথভাবে সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ, শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসমস্ত বৈঠকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশনকে কারিগরি সহায়তা সহ সব ধরনের সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন ফলকার টুর্ক। দুই দিনের সফর শেষে ফিরে যাওয়ার প্রাক্কালে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন ফলকার টুর্ক। এসময় ঘুরে ফিরে বারবার সামনে আসে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি। যেখানে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্নে বাংলাদেশের মানবাধিকার ইস্যুতে সুস্পষ্ট বক্তব্য দেন তিনি। বিশেষ করে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকে ঘিরে পুলিশ হত্যা, আন্দোলন পরবর্তী সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় মব জাস্টিস চর্চা, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার ভিত্তিতে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা, ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ সহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য রেখেছেন তিনি। যেখানে পরিষ্কার হয়েছে যে, পরিবর্তিত অবস্থাতে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এখনো মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি, এখনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং অনাকাঙ্খিত। আমরা যদি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারি তাহলে মূল্যহীন হয়ে যাবে আমাদের সংস্কার প্রক্রিয়া। সেজন্য সংস্কারের পাশাপাশি আমাদের মানবাধিকার ইস্যুটির দিকে সজাগ নজর দিতে হবে। ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত অবস্থায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় আক্রোশের বশে যেসমস্ত মামলা হয়েছে সেগুলোর যেন নির্মোহ তদন্ত হয়, কোন নির্দোষ ব্যক্তিকে যেন হয়রানির শিকার হতে না হয়। আমরা যেন সত্যিকার অর্থে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে পারি, যেখানে প্রত্যেকের মানবাধিকার সুরক্ষা হবে।
Comments
Leave a Comment