Post Thumbnail

সরকারের মুখের কথা আর মনের কথা


সৈয়দ বোরহান কবীর: ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ তিন মাস হতে চলেছে। সাধারণত একটি সরকারের প্রথম তিন মাস সময়কে বলা হয় ‘হানিমুন পিরিয়ড’ বা মধু চন্দ্রিমার কাল। এই মধু চন্দ্রিমার সময় সাধারণ মানুষ তাদের সব দোষ-ত্রুটিকে উপেক্ষা করে। তাদের ভালো-মন্দ বিচার করে না। বরং সরকারকে সুযোগ দিতে চায়, অপেক্ষা করতে চায়। এই তিন মাস সময় সরকার কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে আর তা জনগণের বিরুদ্ধে গেলেও জনগণ সেই সমস্ত সিদ্ধান্তগুলোকে একরকমভাবে মেনে নেয়। এই সরকারের ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপটটি ছিলো ভিন্ন। একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অর্থাৎ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের নিয়োগ কর্তা। 

গত তিন মাসে সরকার যে কথাগুলো বলছে সেই কথাগুলোর সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে খুব কম। প্রশ্ন উঠেছে সরকারের মুখের কথা আর মনের কথা কি এক? প্রথমত এই সরকার যে কথাগুলো বলছে বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে অন্য চিত্র। এই সরকার দায়িত্ব নিয়েই বলেছিলো যে, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করাই তাদের প্রধান কাজ। কিন্তু গত প্রায় তিন মাসে সরকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে দারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সাধারণ মানুষ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে শুধু উদ্বিগ্ন নয় রীতিমতো আতঙ্কিত বটে। বিভিন্ন স্থানে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি ঘটছে। কিন্তু সরকার পুলিশ-প্রশাসনকে এখন পর্যন্ত পুনরুজ্জীবিত করতে পারেনি। হতোদ্যম পুলিশ এখন পর্যন্ত অকার্যকর। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, তারা পুলিশ প্রশাসনে সংস্কার করবে। ইতোমধ্যে পুলিশ সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুলিশের সেই মনোবল ফিরে আসেনি। ২২ অক্টোবর বঙ্গভবন ঘেরাও এর চেষ্টা করে কিছু সংগঠন। এসময় পুলিশের উপর আক্রমণ করা হয়। পুলিশ যতোক্ষণ পর্যন্ত, স্বাভাবিক অবস্থায় বা ছন্দে না ফিরবে ততোক্ষণ পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। 

সরকারের জন্য একটি বড় দায়িত্ব ছিলো দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা। অভিযোগ ছিলো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছিলো এবং এই সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এজন্যই জিনিস পত্রের দাম উর্ধ্বমুখী। এখন আওয়ামী লীগ সরকার আর নেই। সিন্ডিকেট যদি থেকেও থাকে তাহলে সেই সিন্ডিকেট ভেঙ্গে ফেলা বর্তমান সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং সাধারণ মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সব ধরনের কর্মকান্ড রীতিমতো স্থবির হয়ে আছে। এমনকি প্রশাসনের কর্মকান্ডেও গতি নেই। এ অবস্থা চলমান থাকলে অর্থনীতি অচিরেই যে মুখ থুবড়ে পড়বে এটি সরকারও খুব ভালো মতো জানে। কিন্তু সরকারের মুখের কথা তা বলছে না। সরকারের মনের খবর ক’জন জানে। 

এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে কিছু পরিবর্তনের কথা বলেছে। প্রথম যে কথাটি সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়েছিলো, তাহলো এটি দ্বিতীয় স্বাধীনতা। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। এখানে যে কেউ তার মত প্রকাশ করতে পারবে। আবার মুক্তিযুদ্ধের কথা বললে বা বঙ্গবন্ধুর কথা বললে তার উপর চড়াও হচ্ছে। ক্ষমতাবানরা তাকে নানা রকম হয়রানির শিকার করছে। তাদের নিরাপত্তাও দেয়া হচ্ছে না। আর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মন খুলে তাদের সমালোচনা করার জন্য। আবার সমালোচনা শোনার সংস্কৃতি এখন পর্যন্ত সরকারের মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সরকার  একদিকে বলছে গণমাধ্যম সম্পূর্ণ স্বাধীন। গণমাধ্যম যা খুশি লিখতে পারবে। কোন গণমাধ্যম বন্ধ করা হয় নি। অন্যদিকে গণমাধ্যমের বিভিন্ন কর্মীদের নামে হত্যা মামলা, তাদের ব্যাংক হিসেব তলব, অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিলের মতো ঘটনা গুলো গণমাধ্যমে রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন এবং সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারবে তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিভিন্ন মহল কথায় কথায় গণমাধ্যম আক্রমণের হুমকি দিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে কোন গণমাধ্যমকে হুমাকি দেয়া বা গণমাধ্যমের অফিসে আক্রমণ বরদাস্ত করা হবে না। এজন্য প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, কালবেলা, সমকাল পত্রিকার অফিসে পুলিশি প্রহরা বসানো হয়। কিন্তু যারা হুমকি দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না সেই প্রশ্ন উঠেছে। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হর হামেশাই গণমাধ্যমের চরিত্র হননের খেলা চলছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ কিংবা ‘ভারতের দালাল’ ইত্যাদি নানা অভিধায়ে অভিযুক্ত করে রীতিমতো চাপের মধ্যে রাখা হয়েছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে গণমাধ্যম কতোটা স্বাধীন এবং সক্রিয়ভাবে কাজ করবে সেটি ভেবে দেখার বিষয়। সরকারের মুখের কথার সাথে মনের কথার কতটুকু মিল আছে? 

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা দ্রুত নির্বাচন দেবে। এনিয়ে বার বার সরকারের বক্তব্য পরিবর্তন হচ্ছে। কখনো বলা হচ্ছে, নির্বাচন হবে আগামী বছর। আবার কখনো বলা হচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা যখন বলবেন তখন। নির্বাচনের বিষয়ে আসলে কোন সুস্পষ্ট রোড ম্যাপ তৈরি করা হয়নি। আসলে সরকারের নির্বাচন ভাবনা কি, নির্বাচন নিয়ে সরকার কি করতে চায় এবিষয়ে সরকারের তরফ থেকে কোন স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আইন উপদেষ্টা ২৯ অক্টোবর বলেছেন, নির্বাচনী যাত্রা শুরু হলো। কিন্তু এই যাত্রার সমাপ্তি কোথায়?

সরকার কাউকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার জন্য অনুরোধ করছে। কিন্তু একের পর এক নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটছে। কতগুলো দুর্ভাগ্যজনক মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটেছে। এই সব বিষয় নিয়ে তদন্ত হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে কোন তথ্য কারো কাছেই নেই। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বলা হচ্ছে, তারা কারো বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে না, প্রতিহিংসা করবে না। কিন্তু বাস্তবতার নিরীখে এই কথাকে কেবল কথার কথা মনে করছেন অনেকে। সবকিছু মিলিয়ে সরকারের মুখের কথা আর মনের কথার মধ্যে কেমন যেন একটা ফারাক, যতোই দিন যাচ্ছে ততোই সেই ফারাক দীর্ঘ হচ্ছে। একধরনের সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে সর্বত্র। আওয়ামী লীগ সহ ১১টি রাজনেতিক দলকে নিষিদ্ধের ঘটনার কথায় ধরা যাক। দুইজন সমন্বয়ক হৈ চৈ করে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো কোন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার চিন্তা সরকারের নেই। তাহলে দুইজন রিট আবেদন করলেন কেন? এই সরকার তো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরই অংশ। কেননা, প্রধান উপদেষ্টা দাবি করেছেন , বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের নিয়োগ কর্তা। তাহলে তাদের নিয়োগ কর্তারা যখন ১১টি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের জন্য আবেদন করেন তখন সরকারের অবস্থান কি সেই প্রশ্নটি থেকেই যায়। পরে তারা আবার রিট আবেদনটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে (সোমবার) বলা হয়, কোন রাজনৈতিক নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা তাদের নেই। আবার যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট দলের বাংলাদেশে কোন জায়গা নেই।’ কোনটা আসল কথা? 

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতেও নিয়োগকর্তাদের সাথে সরকারের সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন। এই ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম এক সপ্তাহে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। বিএনপি এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট জবাব দিয়েছে। তারা বলেছে, সংবিধােেনর বাইরে গিয়ে কোন কিছু করা ঠিক হবে না। ফলে রাষ্ট্রপতি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, সরকার এবং বিএনপি’র মধ্যে একটি ত্রিমুখী অবস্থান তৈরি হয়েছে। সরকারের মনের কথা কি? রাষ্ট্রপতির বক্তব্য মানব জমিনে প্রকাশিত হবার পর আইন উপদেষ্টা বলেছেন, রাষ্ট্রপতির পদে থাকার নৈতিক অধিকার নেই। তিনি শপথ লঙ্ঘন করেছেন। শপথ লঙ্ঘনের কথায় যদি বলা হয় তাহলে, উপদেষ্টারাও সংবিধান অনুযায়ী শপথ গ্রহণ করেছেন এবং বর্তমান সংবিধানের ৪(ক)-তে বলা হয়েছে প্রত্যেকটি সরকারি অফিসে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দৃশ্যমান থাকতে হবে। এছাড়াও সংবিধানে জাতির পিতার কথা বলা হয়েছে। সংবিধান বাতিল না করে এই সংবিধান সুরক্ষার জন্য শপথ নিয়ে একজন উপদেষ্টা বলেছেন, তাদের সরকার বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকার করেন না। এই বিষয়গুলো শপথ লঙ্ঘনের কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সবকিছু মিলিয়ে একধরনের সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে সরকারের ভেতর। সরকারের মধু চন্দ্রিমার সময়কাল শেষ হয়ে যাচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।  

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


Comments

User Avatar

Tipu

2 months ago

সঠিক।

User Avatar

Ali

2 months ago

You are right ✅️

User Avatar

শাহানা পারভীন

2 months ago

দারুন বলেছেন । দুজন সন্ত্রাসী সমন্বয়ক হৈ চৈ করে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করলেন, (যদিও আজকাল রিট মামলা দায়েরের যোগ্যতার পরিধি অনেক বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা লাভ করেছে ) আবার থুক্কু দিয়ে প্রত্যাহারও করলেন । মানুষ এই মুহূর্তে খুব অস্থিরতায় বসবাস করছে তবে বাঙালি চিরকালই হুজুকে তাদের চোখ থাকতে চোখ মেলে দেখে না ,মন থাকতে মনে একটু ভাবনার জায়গাও করে না ।আপনার এই অসাধারণ লেখা এবং আপনার পান্ডিত্যের মাধ্যমে সূক্ষ্মভাবে ‘মনে এক মুখে আরেক‘ যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বুঝতে সুবিধে হয় সেরকম একটি পরিষ্কার ছবি চোখের সামনে অতি দ্রুত তুলে ধরেছেন যা আমাদেরকে বুঝতে অনেক সাহায্য করেছে আপনাকে স্যালুট ।আপনি লিখে চলুন আপনাদের মত নিষ্ঠাবান ন্যায়বান মানুষের লেখা খুব দরকার ।

Leave a Comment


Related Articles