রাজা যায়, রাজা আসে, জনগণের দুঃখ?
রবিন দাস: বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন কমিউনিস্ট বিপ্লবী। উনবিংশ শতাব্দীতে জন্ম নেয়া এই এই বিপ্লবী ‘রাজা আসে যায়’ কবিতায় লিখেছেন, ‘রাজা আসে যায় রাজা বদলায়....... জামা কাপড়ের রং বদলায় দিন বদলায় না...’।
বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার এই লাইনগুলো যেন বাংলাদেশেরই বাস্তব চিত্র। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫৩ বছরে দেশে এই পর্যন্ত অন্তত ১১ জন ব্যক্তি সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ সামরিক শাসক হিসেবে দেশ পরিচালনা করেছেন। এছাড়াও সুশীল সমাজের কয়েকজন ব্যক্তিত্বও সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে ১৯৯১ থেকে পরবর্তী সময়ে এক-এগারোর সরকার ব্যতিত বাকি সময় দেশ পরিচালনা করেছে দুইটি রাজনৈতিক দল। এসময়ে বিএনপি ২ মেয়াদ এবং আওয়ামী লীগ সরকার হিসেবে দায়িত্বে ছিলো ৫ মেয়াদে। সব শেষ গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আরো একবার ক্ষমতার বদল হয়। এ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের টানা ১৬ বছরের রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসেন ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তকালীন সরকার।
তবে, বাংলাদেশের ইতিহাসে সরকার বা রাজার এতো পরিবর্তনের পরও জনগণের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়েছে কি? স্বাধীনতার ৫৩ বছরে যতোগুলো সরকার এসেছে এবং গিয়েছে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ যেন ডাল ভাতের মতো। এ অভিযোগগুলো নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রত্যেকটি অভিযোগই ছিলো জন দুর্গতি বা জন অসন্তোষের অন্যতম কারন।
গণতান্ত্রিক একটি দেশে সরকার হচ্ছে মূলত ঐ দেশের জনগণের প্রতিনিধি। যারা দায়িত্ব নেয় জনগণের কল্যাণে কাজ করার জন্য। জনগণের বিভিন্ন সমস্যা দূর করার জন্য এবং দেশ, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা একটি সরকারের প্রধান এবং অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু গত ৫৩ বছরে দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও দেশের শিক্ষা, চিকিৎসা, অর্থনৈতিক এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাগুলো যেন জনগণের ‘গলার কাটা’ হয়েই থেকে গিয়েছে। বিশেষ করে সীমাহীন দুর্নীতি, দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতিতে জনগণের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে সরকারগুলোকে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করলে জন দুর্ভোগ কিংবা জনরোষের কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে সামনে আসে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-
১. সীমাহীন দুর্নীতি: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা দুর্নীতি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করে দেশ পুনঃগঠনে কাজ করে যাচ্ছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১২ নভেম্বর ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘যারে যেদিকে পাঠাই কেবল চুরি করে।........ দুর্নীতি, দুর্নীতি, উঃ আল্লাহ্। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাব। এতো দুর্নীতিবাজ যে আগে কোথায় ছিল জানি না।” তাঁর এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম সেসময় কিভাবে বেড়ে গিয়েছিলো। ১৯৮২ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। এসময় দুর্নীতির ডাল-পালা যেন আরো বিস্তার পায়। ১৯৮৬ সালে বিট্রেনের দ্য অবজারভার পত্রিকায় এরশাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে এরশাদের বিরুদ্ধে ১৫০ মিলিয়ন ডলার পাচারেরও অভিযোগ করা হয়। এছাড়া সেসময় ওয়াশিংটন পোস্টসহ আরো নানা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে আসে এরশাদের দুর্নীতির ফিরিস্থি।
বিএনপি-জামায়াাত জোট দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদের ঘোষণা দিয়ে ২০০১ সালে ক্ষমতায় এলেও, দুর্নীতি-লুটপাট ও দুর্বৃত্তায়নই এই সরকারের নীতি হয়ে দাঁড়ায়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অতি নিকটজনের নেতৃত্বে ১১১ জন গডফাদারের দৌরাত্ম্য হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। 'হাওয়া ভবন'কে রাষ্ট্রক্ষমতার প্যারালাল কেন্দ্রে পরিণত করা হয় এবং এটি হয় দেশের সমুদয় দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের প্রসূতি কেন্দ্র। বিএনপি-জাময়াত জোটের মন্ত্রী, সাংসদ, নেতা-কর্মী এবং দলীয় প্রশাসনের অকল্পনীয় দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, লুটপাট, চাঁদাবাজি প্রভৃতির ফলে টিআইবি পরপর পাঁচবার বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে ভ‚মিধ্বস বিজয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করে ক্ষমতায় ছিলো দলটি। এসময় দেশে দুর্নীতি যেন হয়ে উঠেছিলো ওপেন সিক্রেট। আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ও নেতাদের বক্তব্যে বারংবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষণা কথা বললেও বাস্তবে তা ছিলো ‘অলীক আশা’। বস্তুত গত তিন মেয়াদে এই দলের ছোট থেকে কেন্দ্রের বেশিরভাগ নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের অভিযোগ উঠেছে। গেøাবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগরিটি (জিএফআই) হিসাবে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সেই হিসাবে ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা।
২. দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি: বাংলাদেশের জনগণের দুঃখের আরেকটি গল্প দ্রব্য মূল্য। প্রায় প্রতিটি সরকারের আমলেই দ্রব্য মূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধি জনগণকে পাগল প্রায় করে তুলেছিলো। তবে দ্রব্য মূল্যের বৃদ্ধির সব রেকর্ড ছাপিয়ে যায় ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতের জোটাধীন সরকারের আমলে। এসময় আগের সরকারের তুলনায় ১০০ থেকে ২০০ গুণ বৃদ্ধি পায় দ্রব্য মূল্য। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলেও এটি লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে শেষ ৫ বছরে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিলো ব্যাপকভাবে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির তথ্যমতে, দেশে গত পাঁচ বছরে শুধু ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৩১০ শতাংশ পর্যন্ত। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. ইউনূসের অধীনে অন্তবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরও এ দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকে। বিশেষ করে এসময় প্রায় প্রতিটি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়।
৩. মত প্রকাশের স্বাধীনতা: মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাংলাদেশের মানুষের অন্যতম একটি সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই এই মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি যেনসংবিধানেই আবদ্ধ। ক্ষমতায় বসা প্রত্যেক রাজনৈতিক দল, সামরিক শাসক কিংবা সুশীল সমাজের ব্যক্তিত্ব মানুষের মত প্রকাশের অধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়েছে। বিরুদ্ধ মত দমনই যেন হয়ে উঠেছে শাসকদের অন্যতম প্রধান কাজ। ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের পরে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছিল দেশে প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাবে। এমনকি এই অন্তবর্তীকালীন সরকার থেকে এও বলা হয়েছিলো যে, প্রয়োজনে তাদের সমালোচনা করতে কেউ যাতে কুণ্ঠিত বোধ না করে। কিন্তু বর্তমানে এই সরকার হাটছে উল্টো পথে। কেউ বঙ্গবন্ধু কিংবা ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কথা বললেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কৌশলে। যা থেকে প্রমাণিত হয় মত প্রকাশের স্বাধীনতা কথাটি কেবলই ‘কথার কথা’।
৪. চাঁদাবাজি: বাংলাদেশের মানুষের কাছে আরেকটি আতংকের নাম চাঁদাবাজি। যা সমাজে একপ্রকার ক্যান্সারের মতো আকার ধারণ করেছে। দিন দিন কেবল এর দৌরাত্ম বেড়েই চলেছে। তবে এ চাঁদাবাজি বাড়লেও সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা সংশ্লিষ্টরা যেন ‘চোখ থাকিতে অন্ধ’। প্রশাসন আইনগতভাবে তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করার কারণে এটি দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েই যাচ্ছে।
৫. যানজট: বাংলাদেশের মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী যানজট। গত কয়েক দশক থেকেই দেশে যানজট সমস্যা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেয়েই যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতিদিন ৮২ লক্ষ কর্মঘন্টা নষ্ট হয় যানজটের কারণে। তবে, সমস্যার জন্য যতোটা সরকার দায়ী ঠিক ততোটাই দায়ী জনগণ বা সাধারণ মানুষ। যত্র তত্র পার্কিং, ফুটপাত ও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করাও এ সমস্যাটির জন্য অন্যতম কারণ।
৬. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য: শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে জনতার ভয় যেনো এদেশে কোন সমস্যাই নয়। গত কয়েক বছরে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশ কয়েকবার পরিবর্তন আনা হয়েছে। তারপরেও কোন উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। গবেষণায় দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কিউএস-এর করা তালিকায় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৫৫৪।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতের অবস্থার দুদর্শা যে কাউকে ভাবাবে। নানা রকম অনিয়ম এবং দুর্নীতিতে জর্জরিত আমাদের স্বাস্থ্য খাত। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর বেহাল দশা, প্রত্যন্ত অঞ্চলে সু-চিকিৎসার অভাব এবং প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর রমরমা বাণিজ্যের কারণে মানুষ ক্রমশঃ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হতে আগ্রহ হারাচ্ছে। আর এসব কারণে দেখা যায় প্রতি বছরে অন্তত ২৫ লক্ষ লোক বাংলাদেশ থেকে ভারতে যান চিকিৎসার জন্য।
Comments
Arjun das
2 months agoবর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এমন লেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Rubel Das
2 months agoসৃজনশীল মত প্রকাশের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকুক এটাই প্রত্যাশা.....
Abdul Mohsen Forkan
2 months agoসুন্দর আলোচনা। স্বাধীনতার এত বছর পরেও অন্ন চিন্তা থেকে বাংলাদেশ এর সাধারণ মানুষ মুক্তি পায়নি।
Ranojit Chakraborty
2 months agoপড়ে ভালো লাগলো, অসাধারণ লেখা❤️
Alfred daru
2 months agoAwesome your writing speach . ( great ) and carry on bro .
Leave a Comment