জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র: অস্তিত্ব প্রশ্নে বাংলাদেশ?
আগামীকাল ৩১ ডিসেম্বর জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে যাচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে এদিন রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিকাল ৩টায় প্রকাশ করা হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের দাবি, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের রক্ত দিয়ে পুরোনো ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করবে তরুণ ছাত্র-জনতা। জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের মাধ্যমেই প্রতিফলন হবে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার। এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে মুজিববাদী ৭২’র সংবিধানের কবর রচিত হবে। এদিকে ওইদিন সকালে কেন্দ্রীয় সম্মেলন ডেকেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। সকালে ছাত্রশিবিরের সন্মেলন এবং বিকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের কর্মসূচি- এই দুই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ট্রল সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ বিষয়টিকে একই পক্ষের দুই কর্মসূচি বলে মন্তব্য করছেন। কর্মসূচি যারই হোক না কেন জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের ৫ মাস পর এখন হঠাৎ করে ঘোষণাপত্র দেওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে। ঘোষণাপত্র নিয়ে দেশের কোন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গেও কোন ধরনের আলোচনা বা পরামর্শ না করার অভিযোগ উঠেছে। ফলে এ ধরনের উদ্যোগ জাতিকে আবার বিভক্তির দিকে ঠেলে দিবে নাকি সেই প্রশ্নটিও সামনে আসছে।
গতকাল রাজধানীর বাংলামোটরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। সেখানে সংগঠনটির আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা চাই, মুজিববাদী সংবিধানকে কবরস্থ ঘোষণা করা হবে। যেখান থেকে (শহীদ মিনার) একদফার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, ঠিক সেই জায়গা থেকে মুজিববাদী বাহাত্তরের সংবিধানের কবর রচিত হবে। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি বা রাষ্ট্র কাঠামো হলো বাহাত্তরের সংবিধান, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। এখন যদি সেই বাহাত্তরের সংবিধানকেই কবরস্থ করা হয় বা অস্বীকার করা হয় তাহলে কি আর বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকে? বাহাত্তরের সংবিধানকে অস্বীকার করলে সেটি কি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে অস্বীকার করা নয়? বাহাত্তরের সংবিধানকে কবর দেওয়া হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কি হবে? অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তো বাহাত্তরের সংবিধানের আলোকে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে শপথগ্রহণ করেছে। তাহলে কি সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না? গত ৫ মাস ধরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে সমস্ত নীতিনির্ধারণী গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সেগুলো বৈধতা পাবে কিভাবে? যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো ছাত্র-জনতার বিপ্লবের ম্যান্ডেট নিয়েই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ বলেছেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আমরা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র ঘোষণা করব। সেটা সংবিধানে যুক্ত করে সেকেন্ড রিপাবলিক করার দায়িত্ব সরকারের।’ কিন্তু এর লেজিটেমেসি কি হবে? সংবিধান সংশোধন, সংযোজন বা বিয়োজন করতে পারে একমাত্র জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার। সেক্ষেত্রে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র সংবিধানে কিভাবে সংযুক্ত করা হবে?
আজকের এই বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে বাহাত্তর সংবিধানের রাষ্ট্র কাঠামোর ভিত্তির উপর। কিন্তু সেই বাহাত্তরকে যদি কবর দেওয়া হয় তাহলে বাংলাদেশের কি হবে? বাংলাদেশ রাষ্ট্র কি থাকবে নাকি পাকিস্তানের সঙ্গে আবার একীভূত হয়ে যাবে? যদি পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হয় তাহলে সেটা কোন প্রক্রিয়ায় বা কোন কাঠামোর ভিত্তিতে হবে? - ইত্যাদি প্রশ্ন এখন সামনে আসছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে। বাহাত্তরের সংবিধান অস্বীকার করে মূলত একাত্তরে পরাজিত শক্তি। ফলে এই ঘোষণাপত্রের সঙ্গে একাত্তরের পরাজিত শক্তি বা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির কোন যোগসাজশ রয়েছে কিনা সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সেটি যদি হয়ে থাকে তাহলে এই ঘোষণাপত্রের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
Comments
Leave a Comment